শিশুদের হাতে নিম্নমানের কাগজের নতুন বই, ছিঁড়ে যাচ্ছে মাস পেরোতেই!

চট্টগ্রাম নগরের মিউনিসিপ্যাল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী আসমা খাতুন। বছরের প্রথম দিন তার হাতে উঠেছিল নতুন পাঠ্যবই। বই পেয়ে সেদিন অনেক খুশি হয়েছিল সে। অভিভাবকরাও হয়েছিল দুশ্চিন্তামুক্ত।

তবে আসমার সেই খুশি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ মাস পেরোতেই নতুন পাঠ্যবইয়ের পাতা ছিঁড়ে উঠে যাচ্ছে মলাট! এ সমস্যা শুধু আসমার নয়, তার মতো অসংখ্য শিক্ষার্থীর নতুন পাঠ্যবইয়ের অভিন্ন অবস্থা। এ কারণে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দুশ্চিন্তা বেড়েছে অভিভাবকদেরও।

অভিভাবকদের অভিযোগ, বইয়ের পাতা উল্টাতেই ছিঁড়ে যাচ্ছে। আবার অনেক বইয়ের মলাট খুলে যাচ্ছে। নিম্নমানের কাগজ ও ছাপা এবং সাধারণ বাইন্ডিংয়ের কারণে বইয়ের এমন করুণ দশা। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটছে।

এদিকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগের সঙ্গে একমত পাঠ্যবই সংশ্লিষ্টরাও। তারা বলছেন, এবারের বইয়ের কাগজ খুবই নিম্নমানের। এ কারণে ছাপাও ভালো হয়নি।

এদিকে নতুন বই ছিঁড়ে যাওয়ায় অনেক অভিভাবক পুরাতন বই সংগ্রহ শুরু করেছেন।

নগরের হালিশহর হাউজিং এস্টেট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাহাতের মা বিউটি খানম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, নতুন বইগুলো ছিঁড়ে গেছে। এসব বই দিয়ে পুরো বছর পড়ানো যাবে না৷ তাই আগের শিক্ষাবর্ষে যেসব শিক্ষার্থী পাস করেছে সেসব বই সংগ্রহ করছি। পুরাতন বইগুলো এবারের চেয়ে অনেক ভালো।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কাগজ শিল্পে সংকটের কারণে দেশীয় পাল্প দিয়ে এবার নতুন পাঠ্যবই তৈরি করা হয়েছে। তবে সেখানেও গাফিলতির যেন শেষ নেই। শিশু শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে অফসেট পেপারের চার রঙের বই দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। এসব বইয়ে ৮২ শতাংশ উজ্জ্বলতা থাকার কথা থাাকলেও নিউজপ্রিন্টের কালো কাগজে প্রাথমিকের অধিকাংশ বই ছাপানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর থানা এলাকার বিএন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুশফিকের বাবা শফিক বলেন, এক মাস না যেতেই বইয়ের বেহাল অবস্থা। অনেক পাতায় ঠিকমত লেখা আসেনি। অনেক পাতায় লেখার জায়গায় কালো কালি এসে পড়েছে।

এর আগে গত ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বই বিতরণ উৎসব হয়। তবে প্রতিবার বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হলেও এবার তা সম্ভব হয়নি। কাগজ শিল্পে সংকটের কারণে যথাসময়ে বই ছাপানো সম্ভব হয়নি। চট্টগ্রামের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এবার বইয়ের চাহিদা ছিল অন্তত ৪৮ লাখ।

এনসিটিবির তথ্য বলছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে চার কোটি ৯ লাখ ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ৩৩ কোটি ৯৬ লাখ ৯ হাজার কপি বই ছাপানো হয়। এর মধ্যে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিকে ৯ কোটি ৯২ লাখ ৮৩ হাজার, মাধ্যমিকে ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৮, ইবতেদায়ি শ্রেণিতে দুই কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার, দাখিলে চার কোটি এক লাখ ৪৪ হাজার কপি বই ছাপা হয়। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার বই ছাপা হয় দুই লাখ ১২ হাজার ১৭৭ কপি।

চট্টগ্রাম জেলায় এবার মোট বইয়ের চাহিদা ছিল ১ কোটি ৫৭ লাখ। জানুয়ারির ২০ তারিখের ভেতর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বই পৌঁছলেও বইয়ের মান নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগের শেষ ছিল না।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ফরহাদুল ইসলাম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগ সত্য। খুবই নিম্নমানের কাগজ দিয়ে ছাপানো হয়েছে এবারের বই।

তিনি বলেন, টেন্ডার জটিলতা, ভার্জিন পাল্প না থাকা (কাগজ তৈরির মণ্ড) এবং আমদানিতে সমস্যা থাকায় এমন হয়েছে৷ দেশীয় অর্থাৎ সেকেন্ডারি পাল্প দিয়েই এবার বই ছাপানো হয়েছে। ইতিমধ্যে পেপার মিলের সঙ্গে বসে তাদের ভার্জিন পাল্প আমদানি করতে বলছি। তারা আমাদের কাছে সময় চেয়েছে।

তিনি আরও বলেন, তারা যদি ভার্জিন পাল্প আমদানি করতে পারে সেক্ষেত্রে আসছে বছর আর এমন সমস্যা থাকবে না। এছাড়া বইয়ের ত্রুটি-বিচ্যুতি বের করতে পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন ও প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন কোম্পানি কাজ করে। এবার অধিক সত্যতা যাচাইয়ের জন্য নতুন কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা সারা বাংলাদেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বই দেখে ত্রুটি বের করে আমাদের কাছে রিপোর্ট জমা দেবে। এবার সংকটের ভেতরও যারা গাফিলতি করেছে তাদের জরিমানার আওতায় আনা হবে।

আরবি/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!