মেয়র রেজাউলের ‘ঘনিষ্ঠ লোক’ হামলাকারীরা, আগুনে ঘি ঢালল যেসব ছবি

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে প্রকল্প পরিচালককে মারধর

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রকল্প পরিচালককে মারধরের ঘটনায় নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। কার প্রশ্রয়ে ওই ঠিকাদাররা খোদ করপোরেশনের ভেতর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার গায়ে হাত তোলার সাহস করলো— এই প্রশ্নই এখন মুখে মুখে। কেউ কেউ বলছেন, করপোরেশনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর কারো প্রশ্রয় না পেলে এ ঘটনা করার সাহস করতো না ওই ঠিকাদাররা।

এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) প্রকল্প পরিচালক মো. গোলাম ইয়াজদানীকে মারধর ও হামলাকারীরা সবাই চেনা মুখ। হামলার পরপরই পুলিশের জালে ধরা পড়েছে এদেরই চারজন। বাকিরা এখনো লুকিয়ে রয়েছে।

জানা যায়, হামলার ঘটনার পর চসিকের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন বাদী হয়ে ১১ জনকে আসামি করে খুলশি থানায় মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয় ১০ জনকে।

চসিকের একাধিক সূত্র বলছে, হামলায় অংশ নেওয়া কয়েকজন সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ লোক। এ নিয়ে অনুসন্ধানের মাঠে নামে আলোকিত চট্টগ্রাম। এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর হামলাকারীদের ঘনিষ্ঠ মূহুর্তের একাধিক ছবিও।

গ্রেপ্তার হওয়া ঠিকাদার সঞ্জয় ভৌমিক কংকনের অসংখ্য ছবি রয়েছে মেয়রের সঙ্গে। ছবিতে কংকনের সঙ্গে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী যুবলীগের পদ প্রত্যাশী এম আর আজিমকেও দেখা গেছে। কংকন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শাহ আমানত ট্রেডার্সের মালিক বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সঞ্জয় ভৌমিক কংকন চট্টগ্রাম নগরের ওমরগনি এমইএস কলেজের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া নগর ছাত্রলীগের পাঠাগার সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছাত্ররাজনীতিতে প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী ছিলেন।

কংকন নগরের গোলপাহাড় কেন্দ্রিক ছাত্রলীগের প্রয়াত মহিম উদ্দিন এবং এম আর আজিমের গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। গোলপাহাড় থেকে ফিরে নন্দনকাননের হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর গ্রুপের অনুসারী হিসেবে কাজ করতেন।

চসিকের মেয়র নির্বাচনে এম রেজাউল করিম চৌধুরীর পক্ষে মাঠে বেশ সক্রিয় ছিলেন কংকন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই রাজনীতির মাঠে মেয়রের ঘনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হন সঞ্জয় ভৌমিক কংকন।

মামলার আরেক আসামি সুভাষ দে’র সঙ্গেও মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর একাধিক ছবি রয়েছে। সুভাষও মেয়রের কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত। কখনো নিজেকে কখনো ছাত্রলীগ নেতা, আবার কখনো যুবলীগ নেতা পরিচয় দেন সুভাষ। তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম জয় ট্রেডার্স।

এছাড়া হামলায় জড়িত আরেক অভিযুক্ত আশীষ বাবু যুবলীগের কর্মী বলে জানা গেছে। তিনি জ্যোতি এন্টারপ্রাইজের মালিক। চসিকের বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করার কারণে প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে—এ তথ্য দিয়েছে চসিকের প্রকৌশল বিভাগের একাধিক সূত্র।

এদিকে সিটি করপোরেশনে ওই দিনের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজে ঠিকাদার শফিউল আলম শফিকেও দেখা গেছে। তিনিও মেয়রের কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত। ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকলেও মামলায় নেই শফির নাম। তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগ আলকরণ ওয়ার্ডের আহ্বায়ক বলে জানা গেছে। তার সঙ্গে মেয়রের কয়েকটি ছবি এসেছে এ প্রতিবেদকের কাছে। তিনি চসিক নির্বাচনে মেয়র রেজাউলের পক্ষে মাঠে ছিলেন।

হামলার পর মেয়র গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘এস জে ট্রেডার্সের মালিক সাহাব উদ্দিন এ ঘটনার মূল হোতা।’

মূল হোতা বলা হলেও সিসিটিভির কয়েকটি ফুটেজে সাহাব উদ্দিনের কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

হামলার পর নগরের খুলশী থানায় দায়ের করা মামলার আসামিরা হলেন— এস জে ট্রেডার্সের সাহাব উদ্দিন, শাহ আমানত ট্রেডার্সের সঞ্জয় ভৌমিক কংকন, মাসুদ এন্টারপ্রাইজের মো. ফেরদৌস, জয় ট্রেডার্সের সুভাষ দে, মেসার্স খান করপোরেশনের হাবিব উল্ল্যাহ খান, মেসার্স নাজিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের নাজিম, মেসার্স রাকিব এন্টারপ্রাইজের ফিরোজ, ইফতেখার অ্যান্ড ব্রাদার্সের ইউসুফ, জ্যোতি এন্টারপ্রাইজের আশীষ বাবু, ফরহাদ ও মাহমুদ উল্লাহ।

মামলার পর অভিযানে চার অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা হলেন—সঞ্জয় ভৌমিক কংকন, সুভাষ দে, মো. ফিরোজ ও মাহমুদ উল্লাহ।

চারজনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন খুলশি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা। হামলায় জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

এর আগে ঘটনার দিন করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা জোনায়েদ কবীর সোহাগ ও আইন কর্মকর্তা মনীষা মহাজন। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। চসিকের প্রধান নির্বাহী শেখ মু. তৌহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ আদেশ দেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত, রোববার (২৯ জানুয়ারি) বিকেলে টাইগারপাসে চসিকের অস্থায়ী ভবনের চতুর্থ তলায় নিজ কার্যালয়ে হামলার শিকার হন প্রকল্প পরিচালক মো. গোলাম ইয়াজদানী। তিনি স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী। অবকাঠামো উন্নয়নে চসিকের ২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প সরকার অনুমোদন দেওয়ার পর ইয়াজদানীকে এ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) করে চসিকে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়।

প্রকল্পের আওতায় গত ডিসেম্বরে ২২০ কোটি টাকার ৩৭টি উন্নয়নকাজ তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ভাগ করে দেওয়ার অভিযোগ আনেন কয়েকজন ঠিকাদার। এর জেরেই প্রকল্প পরিচালকের রুমে ঢুকে ভাংচুরের পাশাপাশি তাঁকে বেধড়ক পেটান কয়েকজন ঠিকাদার। অভিযোগ রয়েছে— নাজিম, সুভাষ, শাহাব উদ্দিন, সঞ্জয় ভৌমিক কংকন, হাবিব ও মো. ফেরদৌসের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জন ঠিকাদার হামলায় অংশ নিয়েছিলেন।

আরএস/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!