মহিউদ্দিন চৌধুরী : যেমন ছিলেন ‘চট্টলবীর’

চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ বুধবার (১৫ ডিসেম্বর)। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামের বক্স আলী চৌধুরী বাড়ির রেল কর্মকর্তা হোসেন আহমদ চৌধুরী এবং মা বেদুরা বেগমের ঘর আলোকিত করে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি।

বাবার চাকরির সুবাদে মহিউদ্দিন চৌধুরী পড়াশোনা করেছেন মাইজদি জেলা স্কুল, কাজেম আলী ইংলিশ হাই, আর প্রবর্তক সংঘে।

স্কুলজীবনে কিশোর মহিউদ্দিন ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের তিনবারের মেয়রসহ চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতিত্ব করেন।

১৯৬২ সালে এসএসসি পাস করে বাবার আদেশে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ভর্তি হন তিনি। সেখানের পাঠ না চুকিয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই কমার্স কলেজ, পরে সিটি কলেজে লেখাপড়া করেন তিনি।

মহিউদ্দিনের রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি সিটি কলেজেই হয়। ১৯৬৫ সালে এইচএসসি এবং ১৯৬৭ সালে ডিগ্রি পাস করেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং পরে আইন কলেজে ভর্তি হলেও ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি তিনি।

রাজনৈতিক জীবনের শুরতেই জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। একাত্তরে গঠন করেন ‘জয় বাংলা’ বাহিনী।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিতে গিয়ে তিনি পাক বাহিনির কাছে গ্রেপ্তার হন অসংখ্যবার। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে আইএসআইয়ের চট্টগ্রাম নেভাল একাডেমি সদর দপ্তরের কাছে গ্রেপ্তার হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন দীর্ঘ চার মাস।

এদিকে মহিউদ্দিন শহীদ হয়েছেন ভেবে ছেলের নামে ফাতেহা পড়িয়েছিলেন বাবা বক্স আলী চৌধুরী। এরই মাঝে মানসিক রোগীর অভিনয় করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে পালিয়ে ভারতে পাড়ি জমান মহিউদ্দিন। সেখানে উত্তর প্রদেশের তান্ডুয়া সামরিক ক্যাম্পে প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্কোয়াডের কমান্ডার নিযুক্ত হন। ছিলেন ভারত-বাংলা যৌথবাহিনীর মাউন্টেন ডিভিশনের অধীনে। সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে সক্রিয়ভাবে সম্মুখসমরে অংশ নেন।

এরপর শ্রমিক রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। যুবলীগের নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে ‘মুজিব বাহিনী’ গঠন করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ওই সময় ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করা হলে অল্পের জন্য তিনি ধরা পরা থেকে বেঁচে যান, মৃত্যুবরণ করেন সাথী মৌলভি সৈয়দ।

পালিয়ে গিয়ে ভারতের কলকাতায় বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ দেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। লক্ষ্য ছিল- সামরিক জান্তা, খুনি মোশতাককে সামরিকভাবেই পরাস্ত করা। ১৯৭৮ সালে দেশে ফেরেন। কিছুদিন পরেই দলের নির্দেশে পন্থা পরিবর্তন করে আবার সক্রিয় হন প্রকাশ্য রাজনীতিতে। দেশে এসেই নির্যাতন ও একের পর এক কারাভোগের শিকার হন এ নেতা।

১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ২০০৫ সালের মেয়র নির্বাচনে তিনি ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন মন্ত্রীকে পরাজিত করে তৃতীয়বারের মতো চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচিত হন। পাশাপাশি প্রতিপক্ষের তুলনায় ভোটের ব্যবধানও বাড়ে।

স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে চট্টগ্রামে স্বয়ং জান্তা প্রধানকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে তিনি চক্ষুশূল হন সরকারের। ফলে আবারও রাজনৈতিক বন্দী। ততদিনে চট্টগ্রামের আপামর জনতার নয়নমনি হয়ে উঠেন মহিউদ্দীন চৌধুরী।

একানব্বইয়ের ঘুর্ণিঝড়ে দুস্থ জনতার পাশে দাঁড়িয়ে, অসহযোগ আন্দোলনে খালেদা সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, গরিব-দুখী শ্রমিকের অধিকারের কথা বলে চট্টগ্রামবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নেন ‘চট্টলবীর’ মহিউদ্দিন চৌধুরী।

আরএস/এসআই

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!