ভুয়া ওয়ারেন্টে নিরীহ নাগরিকের কারাভোগ : বিএইচআরএফ’র উদ্বেগ

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা

দেশে বিভিন্ন সময়ে ভুয়া ওয়ারেন্ট, নামের মিল থাকা বা নাম বিভ্রাটে নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ কারাভোগ করছে। এ অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন-বিএইচআরএফ।

এমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।

সংগঠনের চেয়ারপারসন ও প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান, মহাসচিব রাজীব সামদানী, ডিরেক্টর (অর্গানাইজিং) অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহ্‌সান, ডিরেক্টর (ফিন্যান্স) আহমেদ মেহেদী সামদানী ও পরিচালক সদস্য অংশু আসিফ পিয়াল এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, আমরা গভীর উৎকণ্ঠার সাথে লক্ষ্য করছি যে, শুধুমাত্র নামের মিল থাকা ও নাম বিভ্রাটের কারণে কিছু নিরীহ, নিরাপরাধ নারী পুরুষকে কারাভোগ ও চরম হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসার পরেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে না এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে না। অথচ নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান ও মৌলিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে।

বিবৃতিতে তারা আরও বলেন, বাংলাদেশে বিনা দোষে বছরের পর বছর কারাদণ্ড ভোগ করার বহু নজির রয়েছে। যা বন্ধ হওয়া দরকার। ভুয়া ওয়ারেন্টে নিরাপরাধ ব্যক্তির হাজতবাসের ঘটনাও ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে একাধিকবার প্রকাশ হয়েছে।

এ ব্যাপারে রাষ্ট্র, সরকারপ্রধান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করে তারা আরও বলেন, সম্প্রতি চট্টগ্রামে দেখা গেছে অপরাধ না করেও দেড় বছর কারাভোগের পর অবশেষে মুক্তি পায় হাসিনা বেগম (৪০) নামের এক নিরীহ নারী। জামিনে যাওয়ার পর মাদক মামলায় ছয় বছরের সাজাপ্রাপ্ত প্রকৃত আসামি হাসিনা আক্তারের বদলে সাজা ভোগ করে টেকনাফের এই নিরাপরাধ নারী। তিনি ইতোমধ্যে মুক্তি পেলেও তার সবকিছু তছনছ হয়ে যায়।

আরও পড়ুন : ‘মিনুকে জেল খাটানো’ সেই কুলসুমী পুলিশের জালে

নিজের নাম ও স্বামীর নাম মিল থাকায় ঢাকার পল্লবী থানার মিরপুর ১১ নং বাউনিয়াবাঁধ এলাকার রাহিমা বেগম নামে এক গরীব মহিলা মাদক মামলায় একাধিকবার জেল খাটেন। যার কারণে তাকে এলাকায় মানহানিরও শিকার হতে হয়।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে স্ত্রী ও দেড় বছরের সন্তানকে নিয়ে বিছানায় বসে খাবার খাচ্ছিলেন হালুয়াঘাটের মনিকুড়া গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী রাজিব মিয়া। এ সময় হঠাৎ হালুয়াঘাট থানা পুলিশ ঘরে ঢুকে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলার ওয়ারেন্ট আছে বলে হাতকড়া পরিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। পরদিন আদালতের মাধ্যমে পাঠানো হয় কারাগারে। অস্ত্র মামলায় এক বছর নয় মাস জেল খাটা পলাতক এক আসামির সঙ্গে নামের মিল থাকায় এই পরিণতির শিকার হতে হয় তাকে। তিন মাস কারাভোগের পর মুক্তি পান প্রতিবন্ধী রাজিব মিয়া। ২০১৫ সালে কোতোয়ালী থানায় ডাকাতি ও অস্ত্র মামলায় আসামি মো. রাজিবের ঠিকানা লেখা হয় হালুয়াঘাটের মনিচুড়া। তবে চার্জশিটে লেখা হয় সঠিক ঠিকানা- শেরপুর জেলার মালিতা বাড়ির বিজগিরি পাড়া।

সাম্প্রতিক সময়ে এরকম একটি আলোচিত মামলা ছিল জনৈক পাটকল শ্রমিক জাহালামের ঘটনা। যিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের ভুল তদন্ত এবং এক ব্যাংক কর্মকর্তার ভুল সাক্ষ্যের কারণে তিন বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন। পরে মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে আসে জাহালাম নিরাপরাধ। পরবর্তীতে আদালতের সব মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পান জাহালাম।

মানবাধিকারের তথ্যানুসন্ধানে আরো দেখা যায়, ২০০৬ সালের জুলাইয়ে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার রহমতগঞ্জ এলাকায় কোহিনুর আক্তার ওরফে বেবী নামের এক নারী খুনের মামলায় রায়ের দিন অপরাধী কুলসুমী আদালতে অনুপস্থিত না থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে সাজা পরোয়নাসহ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরে ২০১৮ সালের ১২ জুন মিনু নামের এক মহিলাকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমী সাজিয়ে আত্মসমর্পণ করানো হয়। অথচ সে কুলসুমী নামের কাউকে চিনে না এবং এই মামলার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততাও নেই।

২০১৭ সালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে ইয়াবাসহ আটক হওয়ার ঘটনায় হাসিনা আক্তারের কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছিল। তবে নামের একাংশে মিল থাকায় তার জায়গায় প্রায় দেড় বছর ধরে সাজা খাটেন হামিদ হোসেনের স্ত্রী হাছিনা বেগম। নামে মিল থাকায় বিনা দোষে গত দেড় বছর ধরে চট্টগ্রাম কারাগারে ছিলেন।

টেকনাফের হাছিনা বেগম (৪০)। মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি একই এলাকার হাসিনা আক্তারের বদলে আটক করে পুলিশ আদালতে চালান করেন ভুক্তভোগী হাছিনা বেগমকে। এরপর থেকেই স্বামী-সন্তান ছেড়ে বিনা দোষে জেল খাটছিলেন তিনি।

বিএইচআরএফ আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদের তথ্যানুসন্ধ্যানে তা প্রকাশ পায় ও তিনি উক্ত ভিকটিমের জামিনের আবেদন করে তাকে মুক্তি করেন। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের করা এক মামলার তদন্তে মূল আসামির নাম ও তার বাবার নামের সঙ্গে মিল থাকায় অভিযুক্ত করা হয় আরেক ব্যক্তিকে। পরে সেই ব্যক্তি উচ্চ আদালতে আবেদন করলে দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের ভুল হয়েছে বলে স্বীকার করে। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত নিয়ে ওই ব্যক্তির অভিযোগ প্রমাণিত না হলে তার ১৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারতো।

২০০৭ সালের ২২ অক্টোবর বিজয় রুদ্র নামে এক বিদ্যুৎ শ্রমিকের সাজা হলে বিএইচআরএফ তথ্যানুসন্ধান করে দেখে, আসলে তিনি নিরাপরাধ। তাঁর নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে জাল পাসপোর্ট দিয়ে শার্শা থানায় চোরাচালান মামলায় সাজাপাপ্ত প্রকৃত আসামি অপু চন্দ্রের স্থলে তাকে ফাঁসানো হয়। বিএইচআরএফ তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করে।

বিএইচআরএফ চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট এলিনা খান চাঞ্চল্যকর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নির্দোষ শাহ আলম বাবু ওরফে সুন্দর বাবুকে মুক্তির ব্যবস্থা করেন। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে কাশিমপুর কারাগার থেকে আরমান নামের এক ব্যক্তিকে খালাস করা হয়। যিনি ২০১৬ সাল থেকে কারাগারে ৫ বছর ছিলেন শুধুমাত্র বাবার নামের সঙ্গে মিলের কারণে। ২০০৫ সালে বিস্ফোরক আইনে করা একটি মামলায় একজন আসামির বাবার নাম আর মিরপুরের বাসিন্দা আরমানের বাবার নাম একই। ওই মামলায় আসামিকে ২০১২ সালে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। মামলার মূল আসামি ওইসময় পলাতক ছিলেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলো অনুযায়ী, শুধুমাত্র বাবার নাম একই থাকার কারণে ২০১৬ সালে মিরপুর থেকে আরমানকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। পরে এই বিষয়ে আরমানের পরিবারের পক্ষ থেকে আদালতে রিট করা হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদালত আরমানকে খালাসের রায় দেন। এ ঘটনায় আরমানকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার এবং আরমানকে আটকের ঘটনার দায় নিরূপণে নতুন করে তদন্তের সিদ্ধান্ত দেন আদালত।

গত ১৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার দুপুরে হঠাৎ আব্দুর রাশিদের বাড়িতে হাজির হন মনোহরদী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ওমর ফারুক। ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় চার দিন কারাবন্দি থাকেন আব্দুর রাশিদ নামে ৬৫ বছর বয়সী এক কৃষক। পাঁচ সন্তানের জনক ওই কৃষক নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার তারাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা।

গত বছরের ৭ ডিসেম্বর মেঘনাপাড়ে ব্লকের কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন লিটন। এমন সময় মঙ্গল সিকদার পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের এসআই জসিম উদ্দিন সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান। কেবল নামের মিল থাকায় বিনাদোষে ৯ মাস ধরে কারাগারে আছেন ভোলার লালমোহনের এক দিনমজুর।

আরও পড়ুন : রায়ে ‘আমৃত্যু’ না থাকলে যাবজ্জীবন অর্থ ৩০ বছর

চেক ডিজঅনার মামলায় গলাচিপা পৌর এলাকার মুজিবনগর রোডের সাজাপ্রাপ্ত মো. হাবিবুর রহমানের স্থলে পৌর এলাকার কলেজপাড়ার বনানি এলাকার ৮০ বছরের নিরপরাধ বৃদ্ধকে জেলে পাঠায় পুলিশ। নামের মিল থাকায় বিনা অপরাধে সাতদিন কারাভোগ শেষে মুক্তি পানন পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার মো. হাবিবুর রহমান (৮০)।

২৩ অক্টোবর গভীর রাতে দেওয়ানগঞ্জ থানার এসআই শহিজল হকের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ঘুম থেকে তুলে ধরে নিয়ে যায় কৃষক রেজবুল হাসান লিটনকে (২৪)। শুধু নামের আংশিক মিল থাকায় গ্রেপ্তার ও পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হয় দেওয়ানগঞ্জ পৌর এলাকার রেজবুল হাসান লিটনকে। এর প্রতিকার চেয়ে তার পরিবারের পক্ষ থেকে জামালপুর পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করা হয়েছে।

২০০০ সালের ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার লালদীঘির পাড় এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়। ডাকাতি মামলার আসামির সঙ্গে নামের মিল। বাবার নামও একই। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা ভিন্ন। তবে নামের মিল থাকার খেসারত দিতে হলো কুমিল্লার লেপ-তোশকের দোকানি মো. ইউনুছকে (৫৫)। পুলিশের ভুলে বিনাদোষে কারাভোগ করলেন ৫৮ দিন। অবশেষে আদালতের নির্দেশে মুক্তি পেলেন।

বাদী নেই, আসামি আছে। মামলার কোনো অস্তিত্ব নেই-অথচ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। থানায় সাধারণ ডায়েরি পর্যন্ত নেই, কিন্তু জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে মাসের পর মাস। এমন অদ্ভুত আইন ও বিচার ব্যবস্থাপনার গ্যাড়াকলে পড়ে হাজারো নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ আছেন দৌড়ের ওপর। একের পর এক মামলা দেখিয়ে অনেককে প্রডাকশন ওয়ারেন্টের আওতায় নেওয়া হচ্ছে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে। এক আদালত থেকে অন্য আদালতে। এমন দৃষ্টান্ত ভুরি ভুরি।

বাংলাদেশে বিনাদোষে কারাদণ্ড ভোগ করার ঘটনা প্রচুর হলেও ভুয়া ওয়ারেন্ট ও নাম বিভ্রান্তের কারণে নিরীহ লোকজনকে হয়রানির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

এসি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!