বঙ্গবন্ধুর সৈনিক—চট্টগ্রামের সেই বঞ্চিত বীরকে মনে রেখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা

বঙ্গবন্ধুই তাঁর ধ্যান, আওয়ামী লীগই তাঁর প্রাণ। শপথ নিয়েছিলেন— বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসিতে না ঝুলানো পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনার কাছে কিছু চাইবেন না। জেল-জুলুমও কখনও তাঁকে টলাতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে। তবে দলের জন্য নিবেদিত এই মুক্তিযোদ্ধা বরাবরই বঞ্চিত— এমন মত খোদ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদদের।

না, চট্টগ্রামের এই বীরের বঞ্চনার গল্পটা আর দীর্ঘ হয়নি। একাত্তরের সেই বীরকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিয়েছেন খোদ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর এই অনুগতকে করেছেন আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য।

আওয়ামী লীগ মহলে একটি কথা প্রচার রয়েছে— ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা নাকি কাউকে বঞ্চিত করেন না। আওয়ামী লীগের জন্য নিবেদিত সবাইকে তিনি কোনো না কোনোভাবে প্রাপ্য সম্মান দেন।’ মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছকে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আবার প্রমাণ করলেন— কথাটি স্রেফ প্রচার নয়, বাস্তবতা।

গত ১১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত এক দাওয়াত নামায় মো. ইউনুছকে জাতীয় কমিটির সদস্য মনোনীত করা হয়। শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) গণভবনে জাতীয় কমিটির সভায় যোগ দেন তিনি। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দোয়া নিয়ে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন একাত্তরের এই বীর।

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুকন্যার—সেই সেলিনা, বদলে যাওয়া জীবনের রঙিন গল্পেও আ জ ম নাছির

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমার শ্রদ্ধেয় আপা, আমার নেত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা আপা বিশেষ ক্ষমতাবলে আমাকে জাতীয় কমিটির সদস্য মনোনীত করেছেন। নেত্রীর দোয়া আমার চলার পথের পাথেয়।

জানা যায়, বর্ণিল রাজনৈতিক ক্যারিয়ার রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছের। ছাত্রলীগের স্কুল সভাপতি থেকে তিনি নগর সভাপতিও হন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুল ছাত্রলীগ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় মাধ্যমিক স্কুল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলেন।

১৯৭০ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭২-৭৩ সালে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দুমেয়াদে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দী অবস্থায় চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন।

১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি দুবার বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জাতীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক হন। ১৯৮৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন।

বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে ১৯৬৯ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ১৫ দিন কারাগারে ছিলেন ইউনুছ। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি বাতিলের আন্দোলনে যুক্ত থেকে পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে ৯ মাস সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯৭৬ সালে ‘বিশেষ সামরিক আদালত- ৪’ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলায় ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৮০ সালের ১ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দীজীবন কাটান। চার বছরের কারাজীবনে দুবছর কাটান কনডেম সেলে।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঐতিহাসিক লালদিঘীর ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় পাকিস্তানের পতাকা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেন ইউনুছ। পরদিন ৩ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে চট্টগ্রামের রাজপথ ঘুরেন।

২৭ মার্চ পাক নৌ-কমান্ডোর সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে প্রথম সংঘর্ষ হয় এবং রাইফেলসহ গ্রেপ্তার হন তিনি। ২ মাস ৬ দিন ধরে শারীরিক নির্যাতন সহ্য করে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে পালিয়ে ভারত চলে যান। ভারতের উত্তর প্রদেশ দেরাদুন তানদুয়ায় ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধের সামরিক প্রশিক্ষন নেন তিনি। উচ্চতর গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ইউনুছ।

এদিকে জিয়াউর রহমানের সামরিক জান্তা আমলে ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে গিয়ে ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে গোয়েন্দা সংস্থার হাতে গ্রেপ্তার হন। এরপর তাঁকে ঢাকা সেনানিবাসে ৯ দিন, কুমিল্লা সেনানিবাসে ৩ দিন এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ১ মাস ২৮ দিন শারীরিক নির্যাতন করে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়।

১৯৮০ সালে কারাগার থেকে মুক্তির পর একাধিকবার দিল্লি যান। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি দিল্লির পানদার রোডের বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। এরপর দেশে ফিরে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ওই সময় সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন ডা. এসএ মালেক।

জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মী হিসেবে সবসময় সঙ্গে ছিলেন। সঙ্গে আরো ছিলেন যুবলীগ নেতা আবুল কাশেম মন্টু (সুত্রাপুর), ছাত্রনেতা হুমায়ন, জাহেদ। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে পরিকল্পিত আক্রমণের সময়ে সার্বক্ষণিক নেত্রীর সঙ্গে ছিলেন তিনি। মো. ইউনুছ জানান, ‘সেই সময় সাথে ছিলেন নজীব ভাই।’

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু পরিষদের মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এসএ মালেক, সাবেক মন্ত্রী মরহুম জহুর আহম্মদ চৌধুরী, মরহুম এমএ আজিজ, মরহুম এমএ হান্নান, মরহুম এমএ মান্নান, মরহুম আক্তারুজ্জামান চৌধুরী (বাবু), মরহুম আতাউর রহমান খান কায়সার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশারফ হোসেন এমপি, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহম্মদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক মেয়র মরহুম এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে সুদীর্ঘ সময় সংগঠনের কর্মকাণ্ডে ছিলাম।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ ১৯৫৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাটহাজারীর নুর আলী মিয়ার হাট ফরহাদাবাদ গ্রামের হিম্মত মুহুরী বাড়ির মরহুম নুর হোসেনের সন্তান। তাঁর বাবা ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক উচ্চতর হিসাব কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন: জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা : আ জ ম নাছির

বর্তমানে নগরের দক্ষিণ খুলশী আবাসিক এলাকার ১নং সড়কের ৬৯নং বাড়িতে বসবাস করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ। তিনি উত্তাল একাত্তরে চট্টগ্রাম পূর্বাঞ্চলের সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন। চট্টগ্রাম কারাগার থেকে বি.কম পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি ডিগ্রি পাস করেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ বর্তমানে চট্টগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদের মহাসচিব এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যোদ্ধা ফোরাম ’৭৫-এর আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষা বোর্ড সদস্য, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালের আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলার আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী সমিতির আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম শহর সমাজসেবা প্রকল্প সমন্বয় পরিষদ- ১ এর আজীবন সদস্য এবং পৌর জহুর হকার মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!