পুলিশের প্রশ্রয়েই পংকজ—জুয়েলের মাদক বাণিজ্য, পুলিশ আসে বাঘের গর্জনে—ফিরে জামাই আদরে

নগরের সবচেয়ে কাছের উপজেলা এটি। তবে এই উপজেলায় রয়েছে দুর্গম পাহাড়। এটিকে পুঁজি করেই চলছে মাদক তৈরির উৎসব।

পাহাড়ের সেই মাদক লোকালয়ে আসে দেশি অস্ত্রের মহরায়। পুলিশও নাকি থাকে অন্ধের ভূমিকায়। কারণ প্রতি রাতেই যে পুলিশের পকেটে যায় মাদক কারবারিদের কালো টাকা!

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার ৯ নম্বর আমুচিয়া ইউনিয়নের চিত্র এটি। প্রতিদিন এই ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ে চলে মাদক তৈরি।

মূলত দুটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে বিশাল এই মাদক বাণিজ্য। পংকজ চন্দ ওরফে বাংলা মদ সম্রাট ফাংকু ও জুয়েল ঘোষ ওরফে ইয়াবা গুরু জুলুর নেতৃত্বে রয়েছে মাদকের এই বাণিজ্য। তাঁদের নেটওয়ার্কে দুর্গম পাহাড়ে উৎপাদিত মাদক পৌঁছে যায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়।

ফাংকু-জুলুর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকলেও এলাকায় ঘুরেন তাঁরা বুক ফুলিয়ে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বোয়ালখালীর আমুচিয়া ইউনিয়নের করলডেঙ্গা পাহাড়ের গভীরে চাকমা পাড়াতে তাঁদের রয়েছে দেশি মদ তৈরির কারখানা। রাত হলেই নামে মদ, ইয়াবা ও গাঁজার ভাড় নিয়ে। তাদের সামনে-পেছনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে দেশি অস্ত্রে সুসজ্জিত স্থানীয় মাস্তানরা। তাদেরই নিশ্ছিদ্র পাহাড়ায় আমুচিয়া ৯ নম্বর ইউনিয়নে আসে মাদক।

এখান থেকে মাদক চলে যায় আরেক সিন্ডিকেটের কাছে। আর সেই দালাল চক্রের মূল হোতা শুভ ভট্টাচার্য প্রকাশ গুটি শুভইয়া ও শোভন ভট্টাচার্য। তাঁদের রয়েছে ১৩ জনের এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের এই সদস্যর মাধ্যমেই বিভিন্ন সেল পয়েন্টে যায় মাদক।

এসব পয়েন্টের মধ্যে রয়েছে আমুচিয়ার কানুনগোপাড়ার উত্তর সর্দারপাড়া, জুয়েল, ভোলা ও বিশ্বাস বাড়ির পুকুর পাড়, স্টার বাজার এলাকার কৃপা চক্রবর্তীর বাড়ি ও মুরগির ফার্মের আশপাশ, টিংকু ও প্রবীর ভট্টার্চাযের বাড়ির পেছনে ডোবার পাড় ও খামারের পাশে, ধোরলা গ্রামের (আমুচিয়া ৫ নম্বর ওয়ার্ড) সুরেশের বাড়ি প্রকাশ মহাজন বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়, অন্ধকার জমির পাড় এবং জঙ্গল ঘেরা পাইজ্জাল্ল্যা পুকুর পাড়।

পংকজ ,জুয়েল, শুভ ও শোভনের অস্ত্রের মহড়ায় ডেলিভারি দেওয়া হয় বাংলা মদ, ইয়াবা ও গাঁজার চালান। দেশি অস্ত্রের সরাসরি ডেলিভারি দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

আবার কানুনগোপাড়া বাজারের দোকানের আড়ালেও বিক্রি হয় মাদক। বিশেষ করে ইরফান স্টোরে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আড়ালে মাদক বিক্রির অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

স্থানীয়রা বলছেন, পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে এসব মাদক সিন্ডিকেটের। পুলিশকে মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়ায় পু্লিশ সব দেখেও না দেখার ভান করে। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, আমুচিয়া ইউনিয়ন থেকে দুকিলোমিটার দূরে চাকমা পল্লি। রাত হলেই বিভিন্ন মাদকদ্রব্যর ভার নিয়ে দুর্গম পাহাড় থেকে নামে মাদক কারবারিরা। প্রায় দুকিলোমিটার রাস্তাজুড়ে থাকে বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত তাদের বাহিনী। কিন্তু পুলিশ কি তা জানে না?

আমুচিয়া ইউনিয়নের শংকর দেবনাথ বলেন, পুলিশের টহল গাড়ি আসে প্রতি রাতেই। যে অফিসারই আসুক না কেন, তারা খালি পকেটে এলেও ফিরে যান ভরা পকেটে। মাঝেমধ্যে টাকার লেনদেনের সমস্যা হলেই শুরু হয় ধরপাকড়। তবে টাকা পেলেই মুহূর্তেই সমাপ্তি হয় ধরপাকড় নাটকের।

এদিকে মাদক কারবারির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ৯ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কাজল দে গত ৮ আগস্ট বোয়ালখালী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর অভিযোগ দেন। অভিযোগে তিনি শুভ ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি সরাসরি উল্লেখ করেন।

অপরদিকে অভিযোগের সত্যতা স্বীকারও করেন অভিযুক্ত শুভ ভট্টাচার্য ওরফে গুটি শুভইয়া। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত এক চিঠিতে তিনি উল্লেথ করেন, আমি মদ্য পান, মদ বিক্রি, ইয়াবা বিক্রি ও বিভিন্ন অপরাধের সাথে সরাসরি জড়িত এবং ভবিষ্যতে কোনো অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িত থাকব না। এ ধরনের কোনো অপরাধ করে থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ করে তিনি মুচলেকা দেন।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, শুভ ভট্টাচার্য গ্রাম পুলিশ সদস্য ছিলেন। আর এটিকে ব্যবহার করেই তিনি গড়ে তুলেন ১৩ সদস্যের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ওই ১৩ সদস্যের মাধ্যমেই বিভিন্ন স্পটে সরাসরি মাদক বেচা চলে।

এদিকে আরেক মাদক কারবারি সিন্ডিকেটের প্রধান পংকজ চন্দ ওরফে বাংলা মদ সম্রাট ফাংকু। এলাকায় মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি তাঁর রয়েছে বিশাল গুন্ডা বাহিনী। আর সেই বাহিনীর মাধ্যমেই মাদক বেচার পাশাপাশি এলাকায় চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ বিভিন্ন কাজের চুক্তি নেন।

জানা যায়, গত ২৬ নভেম্বর বেলা সোয়া ১২টার দিকে বোয়ালখালী থানার কানুনগোপাড়া এলাকার মানিক বৈদ্যের বাড়ির নির্মাণাধীন ভবনের মালিক সঞ্জয় চৌধুরীর কাছে লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন পংকজ চন্দ ও তাঁর গ্যাংয়ের সদস্যরা। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সঞ্জয় চৌধুরীকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন তারা।

ঘটনার পরই ভুক্তভোগী বাদী হয়ে চট্টগ্রাম চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পংকজ চন্দসহ আরো ৩ জনকে আসামি করে মামলা করেন।

জানতে চাইলে ৯ নম্বর আমুচিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কাজল দে আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, তাদের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তাদের নামে মাদকের একাধিক মামলাও রয়েছে। এরপরও তাদের থামানো যাচ্ছে না। তাদের এসব কর্মকাণ্ডের জন্য প্রশাসনকে আরো তৎপর হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।

দৃষ্টি আর্কষণ করা হলে বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল রাজ্জাক বলেন, আমার এলাকায় মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স। আর মাদক নিয়ন্ত্রণের গডফাদারের বিষয়ে আপনার থেকেই জানলাম। আমি অবশ্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখব। এসব গডফাদারকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!