ইকোনমিক জোনের স্লুইসগেটে জেলেদের সর্বনাশ

ইলিশের এমন ভরা মৌসুমে মুখে হাসি নেই মিরসরাই উপকূলের জেলেদের। সাগরে যাতায়াতে নৌকার তেল খরচই তুলতে পারছেন না তারা। হাতেগোনা কিছু ইলিশের সঙ্গে কেবল ছোট মাছ জুটছে তাদের কপালে। ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে নেমে এখন অনেকের মাথায় হাত!

অথচ নিষেধাজ্ঞার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তের জেলেরা ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরছেন সাগর থেকে। আর মিরসরাই উপকূলে দেখা যাচ্ছে এর উল্টো চিত্র। এতে দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে জেলে পরিবারগুলো। ইকোনমিক জোনের স্লুইসগেট খুলে দেওয়ার ফলে এমনটা হয়েছে বলে জানান অনেক জেলে।

ইলিশের প্রজনন মৌসুমের কারণে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে ২৪ জুলাই থেকে আবারো সাগরে মাছ ধরতে নামে জেলেরা। কিন্তু দীর্ঘ অপেক্ষার পরও সাগরে প্রত্যাশা অনুযায়ী মাছ না পাওয়ায় জেলেদের কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে।

এদিকে ইলিশ মৌসুমের শুরুতে নৌকা, জাল কেনা এবং মেরামতের জন্য ঋণ নিয়েছিলেন অনেক জেলে। যাতে মাছ ধরে সেই ঋণ শোধ করার পাশাপাশি বাকি টাকায় সংসার চালানো যায়। কিন্তু এখন ঋণ শোধতো দূরের কথা সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।

আরও পড়ুন: ‘জেলেদের কান্না’—অভাবের সংসারেও প্রণোদনার বঞ্চনা, দেখে না কেউই

শুক্রবার (২০ আগস্ট) দুপুরে সরেজমিন ডোমখালী বেড়িবাঁধ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, মাছ ধরার ট্রলারে কিছু ছোট আকারের ইলিশ নিয়ে ফিরে এসেছে জেলেরা। তারা বলেন, প্রতিদিন তেল খরচ করে সাগরে মাছ ধরতে যাই। কিন্তু সবই ছোট মাছ, ইলিশের দেখা নেই। এ ক্ষতি আমরা কেমন করে পোষাবো?

সাহেরখালী ইউনিয়নের ডোমখালী এলাকার জেলে মৃদুল জলদাস আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, মুহুরী প্রজেক্টের স্লুইসগেট খুলে দেওয়ায় এদিকে স্রোত বেড়ে গেছে। সবগুলো মাছ দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। ইলিশ ধরার মৌসুম যদি স্লুইসগেটের ৪০টি দরজা না খুলতো তাহলে আমরা এলাকাতে মাছ ধরতে পারতাম। গেল বছর প্রচুর মাছ পাওয়া গেছে। কিন্তু এ বছর তার ছিটেফোঁটাও নেই।

ডোমখালী এলাকার সীতাকুণ্ড পয়েন্টের জেলে হরিলাল জলদাস বলেন, সাগরে মাছ নেই। দুঃখ-দুর্দশায় দিন কাটছে আমাদের। ছোট কিছু মাছ পাওয়া যাচ্ছে, যা দিয়ে তেলের পয়সা উঠাতেও কষ্ট হচ্ছে।

অপর কয়েকজন জেলে জানান, সাধারণত জুন থেকে আগস্ট এই তিন মাস জেলেদের মাছ ধরার প্রধান সময়। মূলত বর্ষার এই তিন মাসের জন্য জেলেরা সারাবছর প্রহর গুণে। প্রতিবছর এই সময় সমুদ্রে প্রচুর ইলিশের দেখা মেলে। আর এই ইলিশ বিক্রির অর্থ দিয়েই চলে সারা বছরের সংসার।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ভরা মৌসুমেও মিরসরাইয়ে রূপালী ইলিশের আকাল চলছে। জেলেরা জীবন বাজি রেখে ইলিশের প্রধান উৎস্ বঙ্গোপসাগরের গভীরে গিয়েও পর্যাপ্ত ইলিশ পাচ্ছে না। আর কখনো কখনো কিছু ইলিশ ধরা পড়লেও প্রতিজন জেলের ভাগে পড়ে সামান্য কয়েকটি। আর এর প্রভাব পড়ছে স্থানীয় বাজারে। ফলে চড়া হচ্ছে ইলিশের দাম।

সরেজমিন উপজেলার বড়দারোগারহাট, বড়তাকিয়া, হাদি ফকিরহাট, মিরসরাই সদর, মিঠাছড়া বাজারে গিয়ে তেমন ইলিশের দেখা মেলেনি। বড়দারোগাহাট ও মিঠাছড়া বাজারে ইলিশ দেখা গেলেও তা ছোট ও মাঝারি আকারর। এসব চট্টগ্রামের ফিশারিঘাট থেকে এসেছে বলে জানা গেছে।

বড়দারোগারহাট বাজারের প্রবীণ মাছ বিক্রেতা হরি জলদাস আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ইলিশের কথা উঠলে বড় দুঃখ লাগে। এই মৌসুমে আমরা শুধু ইলিশ বিক্রি করেই চলতাম। একদশক আগেও এই সময় সাগরপাড়ে ইলিশের ছড়াছড়ি ছিল। দাম কম হওয়ায় জেলেরা অনেক সময় বাজারে আনতে চাইতো না মাছ। কিন্তু এখন ইলিশ দুর্লভ হওয়ায় জাটকা আকৃতির ইলিশ আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ টাকা এবং মাঝারি সাইজের ইলিশ ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বড় ইলিশতো খুব কম, যা আছে কেজি হাজারের উপরে।

আরও পড়ুন: লাভের মৌসুমেই লোকসান—ফিশিং ট্রলারে সহস্র জেলের সর্বনাশ

উপজেলার ডোমখালী জেলেপাড়ার সাধারণ সম্পাদক বাদল চন্দ্র জলদাস আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, মূলত ফেনী নদীর মুহুরী প্রজেক্ট এলাকাসহ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিভিন্ন পয়েন্টের স্লুইসগেটের দরজা খুলে দেওয়ায় সাগরের স্রোত বেড়ে গেছে। তাছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের কলকারখানার বর্জ্য সাগরের পানি দূষিত করে ইলিশের প্রজনন ধ্বংস করে দিচ্ছে।

এ বিষয়ে মিরসরাই উপকূলীয় জেলে সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হরিলাল জলদাস আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ভরা মৌসুম হলেও বঙ্গোপসাগরের মিরসরাই-সন্দ্বীপ চ্যানেলে পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না।

জেলেদের ইলিশ না পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে মিরসরাই উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা নাসিম আল মাহমুদ আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, তাৎক্ষণিক এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ শেষে জানা যাবে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ইলিশ প্রজননকেন্দ্রের মধ্যে মিরসরাইয়ের সাহেরখালি হাইতকান্দি পয়েন্ট অন্যতম। প্রাথমিকভাবে অনুমান করছি ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনের প্রভাবে এই বিচরণ এলাকা থেকে তারা সরে গেছে।

ডিসি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!