ছাত্রলীগ নেতার আড়ালে ‘ইয়াবা ডন’, সাইফুলের বলয়ে অস্ত্র ও কিশোর গ্যাং

অস্ত্র, ছাত্রী অপহরণ, হত্যাচেষ্টা ও মাদক মামলার আসামি হওয়ার পরও নির্বিঘ্নে ইয়াবা ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুল করিমের বিরুদ্ধে। অর্থের বিনিময়ে থানা পুলিশ ও দলীয় নেতাদের ব্যবহার করে এলাকায় প্রকাশ্যে এসব অপকর্ম চালাচ্ছেন তিনি।

প্রকাশ্যে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেলেও রহস্যজনকভাবে প্রশাসনের ধরাছোঁয়ার বাইরে সাইফুল করিম। আবার অন্যান্য মাদক ব্যবসায়ীদের প্রশাসনের ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

জানা যায়, এলাকায় ‘ইয়াবা ডন’ খ্যাত সাইফুল করিম টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের দরগাপাড়া এলাকার মৃত আবুল কাসেমের ছেলে। সাবেক এ ছাত্রলীগ নেতা প্রথমবারের মতো মাদক মামলায় জড়ান ২০১৫ সালে। ওই বছরের ৩ জানুয়ারি কক্সবাজার সদরের লিংক রোড এলাকার তিশা বাস কাউন্টারের সামনে থেকে তাঁকে ইয়াবাসহ আটক করে কক্সবাজার জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। আটকের পর কক্সবাজার সদর থানায় সোপর্দ করা হলে তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এ মামলায় ৭ মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে বের হয়ে আসেন তিনি।

এদিকে সাইফুল করিমের বিরুদ্ধে চলতি বছরেই টানা দুমাসে টেকনাফ থানায় দুটি মামলা হয়েছে। যার মধ্যে গত ১৬ জুন ২৪ কোটি ৫৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের ক্রিস্টাল মেথ আইস ও ইয়াবা উদ্ধারে বিজিবির করা মামলায় আসামি করা হয় তাঁকে। এর এক মাসের মধ্যে আবারও মাদক মামলায় জড়ান তিনি। গত ৬ জুলাই ৫ কোটি ৬০ লাখ ৪৮ হাজার টাকা মূল্যের ক্রিস্টাল মেথ আইস ও ইয়াবা উদ্ধারের পর আবারও বিজিবির করা মামলায় আসামি করা হয় তাঁকে।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে স্থানীয় এক বাসিন্দা আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, মূলত ৭ মাস কারাগারে থাকার পর জামিনে বের হয়েই সাইফুল অনেক বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠে। মাদক মামলায় জামিনে বের হয়ে সে মাদক ব্যবসায় আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠে। প্রকাশ্যে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যায়। তার মাদক ব্যবসা জোরদার করতে এলাকায় গড়ে তুলেছে বেপরোয়া কিশোর গ্যাং। প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসায় কেউ বাধা দিতে চাইলে সাইফুল তার গড়ে তোলা কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে সন্ত্রাসী হামলা চালায়। সে তার দলবল নিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব করছে।

তিনি বলেন, সে নিজে প্রকাশ্যে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, আবার অন্যান্য ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও সে প্রশাসনের হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় করে। সে তার ইউপি মেম্বার ভাইয়ের দাপট দেখিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব করছে। কোনো চাকরি বা বৈধ কোনো ব্যবসা ছাড়াই সে বর্তমানে অঢেল টাকা ও সম্পদের মালিক। টাকার জোরে সে অনেক মাদক মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও পুলিশের চোখের সামনেই নিয়মিত চলাফেরা করছে এবং নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, মাদক মামলায় ৭ মাস জেলে থাকার পর জামিনে বের হয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন ‘ইয়াবা ডন’ সাইফুল করিম। জেল থেকে বের হয়েই মাদক ব্যবসার কৌশল পাল্টান তিনি। এলাকায় নির্বিঘ্নে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনসহ বেশ কয়েকজন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে টাকার জোরে গড়ে তোলেন সুসম্পর্ক। এরপর থেকে মাদক ব্যবসায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি। এলাকায় গড়ে তোলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী।

প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই হ্নীলা ইউনিয়নের দরগাহপাড়া, নাটমোরাপাড়া, পূর্ব ও পশ্চিম সিকদারপাড়ায় এ বাহিনীর তৎপরতা শুরু হয়। এ সময় প্রকাশ্যে চলে ইয়াবা বাণিজ্য, সেবন ও ইয়াবার চালান লুটপাটসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এতে কঠিন অবস্থা পার করছে এসব এলাকার স্থানীয়রা। তবে তার হামলার শিকার হওয়ার ভয়ে কেউ এসবের প্রতিবাদ করার সাহস পায় না।

একাধিক সূত্র জানায়, সাইফুলের সহযোগী হিসেবে সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসার সক্রিয় সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন— নুর মোহাম্মদ, মাঈন উদ্দিন, ফোরকান, রফিক, এমরান খাঁন, আদনান, মোহাম্মদ নুর, আব্দুল্লাহ, জাফর আলম প্রকাশ টপ জাফর, আবুল হোসাইন প্রকাশ বার্মায়া আবুল হোছাইন, কেফায়েত উল্লাহ প্রকাশ বার্মায়া মাস্টার কেফায়েত, জাহাঙ্গীর আলম, কোকন, মাইনুল করিম, হুমায়ুন করিম, জয়নাল আবেদিন প্রকাশ কালা বদা, শাহ আলম, শামসুল আলম বাবুল, আল ফাহাদ, ফাহাদ ও বনি আমিন।

এদের মধ্যে মাইনুল করিম ও হুমায়ুন করিম হচ্ছেন সাইফুল করিমের ভাই। কেফায়েত উল্লাহ মিয়ানমারের নাগরিক। তাঁর বাড়ি মিয়ানমারের মংডু জেলার নাপপুরা থানায়। ফোরকান মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে জেলে রয়েছেন। ফোরকানের ভাই ও সাইফুলের সহযোগী রফিক মাদক মামলায় জেল কেটে মাসখানেক আগে জামিনে বের হয়েছেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে হ্নীলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুল করিমের মুঠোফোনে ফোন দিলে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর কয়েকবার চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। তাঁর মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।

অভিযোগ রয়েছে, টেকনাফ থানার এসআই রফিকুল ইসলাম রাফি হ্নীলা ইউনিয়নের দায়িত্ব পালনকালে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে সাইফুল করিমের সঙ্গে। সে সম্পর্ককে পুঁজি করে এসআই রাফির সহযোগিতায় একটি মাদক মামলার চার্জশিট থেকে নিজের নাম বাদ দিতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা টেকনাফ থানার এসআই মো. সাজ্জাদ হোসেন সজীব ও টেকনাফ থানার ওসি (অপারেশন) মো. খোরশেদ আলমের সঙ্গে ২০ লাখ টাকার লেনদেনের তৎপরতা চালান সাইফুল করিম। তবে এর মধ্যে গত মাসে টেকনাফ থেকে বদলি হয়ে যান ওসির (অপারেশন) দায়িত্বে থাকা মো. খোরশেদ আলম।

এদিকে খোরশেদ আলমের বদলির পর টেকনাফ থানার ওসি (অপারেশন) পদে যোগ দেন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমি এখানে নতুন যোগ দিয়েছি। আগের ওসির (অপারেশন) দায়িত্বে যিনি ছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সে সম্পর্কে তিনি ভালো বলতে পারবেন। তবে কোনো আসামি বা অপরাধীর বিষয়ে তথ্য পেলে এবং সে তথ্য যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে আমরা যথাসাধ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

এ বিষয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাহফুজুল ইসলাম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, অভিযোগের বিষয়ে আপনাদের মাধ্যমে এখন জানতে পারলাম। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমি খতিয়ে দেখব। যদিও টাকার বিনিময়ে মামলা থেকে কারও নাম বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যেখানে মামলার বাদিও হচ্ছে একটা সরকারি সংস্থা। তাই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বা একজন অফিসার চাইলেই কাউকে মামলা থেকে বাদ দিতে পারবেন না। তারপরও বিষয়টি আমি তদন্ত করে দেখব।

এসপি আরও বলেন, কেউ যদি অপরাধ করে থাকে বা মামলার আসামি হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তার সম্পৃক্ততা কেমন সেটা যাচাই-বাছাই করে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। মানুষজন অনেক সময় অনেক কিছুই তো বলে বা ধারণা করে, সব ক্ষেত্রে তো আসলে তাদের ধারণা শতভাগ সঠিক নাও হতে পারে। মানুষজনের উচিত শেষ পর্যন্ত কী হয় বা আমরা কী পদক্ষেপ নিই সেটা দেখা।

এসআই/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!