চট্টগ্রামে রাতভরের বৃষ্টিতে—সকালেও পানিতে ভাসছে নগর, চরম জনদুর্ভোগ

শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে টানা বৃষ্টিতে ডুবে গেছে পুরো নগর। ভারি বৃষ্টির সঙ্গে জোয়ারের পানি যোগ হয়ে চরম ভোগান্তিতে জনজীবন। রাস্তায় হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি হওয়ায় সংকট দেখা দেয় যাত্রীবাহী গাড়ির। রাস্তায় হাতেগোনা কয়েকটা রিকশা থাকলেও ভাড়া গুণতে হয়েছে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি! এ অবস্থায় হাজার হাজার মানুষকে কাকভেজা হয়ে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরতে হয়েছে।

এদিকে দুর্ভোগের এমন চিত্র ছিল আজ (শনিবার) সকালেও। সকাল সোয়া ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত চলছিল ভারি বর্ষণ। তাই অব্যাহত ছিল জনদুর্ভোগও।

সরেজমিন দেখা যায়, হাঁটু থেকে কোমর পানিতে ডুবে গেছে নগরের চকবাজার, ডিসি রোড, দেওয়ান বাজার, ধনিয়ারপুল, রাহাত্তরপুল, তেলিপাট্টি মোড়, কাপাসগোলা, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, বহদ্দারবাড়ি, বাকলিয়া, চাক্তাই, মুরাদপুর, কাতালগঞ্জ, প্রবর্তক মোড়, ষোলশহর, দুই নাম্বার গেইট, জিইসি, আগ্রাবাদ, হালিশহর, একেখান, পাহাড়তলী, পূর্ব নাসিরাবাদ, জাকির হোসেন বাই লেন, বায়েজিদ, শেরশাহ, অক্সিজেন, সাগরিকা, আগ্রাবাদ সিডিএ, মেয়র গলিসহ অসংখ্য এলাকা। নগরের ৪১ ওয়ার্ডের মধ্যে অন্তত ২৫টি ওয়ার্ডের নিচু এলাকা টানা ভারি বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে ডুবে আছে। এতে ঘরবন্দী হয়ে আছে অনেক মানুষ।

শুক্রবার রাত দশটা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সন্ধ্যা থেকে টানা বৃষ্টির ফলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে চকবাজার, কাপাসগোলা, বহদ্দারহাট, বাকলিয়া, মুরাদপুর, ষোলশহর ও দুই নম্বর গেইট এলাকার বাসিন্দা। এসব এলাকার অলিগলি থেকে শুরু করে মেইন রোড কোমর সমান পানিতে ডুবে আছে। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি দোকানে ঢুকে যাওয়ায় সন্ধ্যার পর থেকে বন্ধ রয়েছে দোকানপাট। কারো প্রয়োজনীয় জিনিস লাগলেও দোকান বন্ধ থাকায় নিতে পারেনি।

তুমুল বৃষ্টিতে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কাপাসগোলা থেকে বড় গেরেজ এলাকার কাঠের দোকানের ব্যবসায়ীরা। সেখানে অনেক দোকানের কাঠ বৃষ্টির তোড়ে রাস্তায় ভাসতে দেখা গেছে। ভেসে যাওয়া কাঠগুলো ধরতে কোমর সমান পানিতে যুদ্ধ করছিলেন কাঠ ব্যবসায়ীরা।

এদিকে মুষলধারে বৃষ্টিতে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে চরম গাড়ি সংকটে পড়েছিল জরুরি কাজে বের হওয়া সাধারণ মানুষ। রাস্তায় হাতেগোনা কয়েকটি মিনি বাস, টেম্পু, অটোরিকশা ছিল। এর মধ্যে বেশকিছু গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে রোডের মাঝখানে অচল পড়ে থাকতে দেখা গেছে। বন্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এমনকি রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

অচল হয়ে যাওয়া গাড়ির যাত্রীদের বাধ্য হয়ে মাঝপথে নেমে যেতে হয়। কোমর সমান পানি দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে তাদের ফিরতে হয়েছে গন্তব্যে। অপরদিকে পানিতে আটকেপড়া গাড়িগুলো চালকদের ঠেলে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করতে দেখা যায়।

বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা রায়হান আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, দুপুরে এয়ারপোর্ট গিয়েছিলাম একটা কাজে। সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে ভারি বৃষ্টি শুরু হয়। তীব্র জ্যাম আর ভারি বৃষ্টির কারণে বহদ্দারহাট পৌঁছাতে রাত ১০টা বেজে যায়। অটোরিকশা নিয়ে আসার সময় চকবাজার পৌঁছালে দেখি রাস্তায় কোমরপানি। আমাকে নিয়ে আসা অটোরিকশাটি কাপাসগোলা বড় গেরেজ এলাকায় পৌঁছলে গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তার মাঝে অচল পড়ে থাকে গাড়ি। উপায় না দেখে আমি ভাড়া দিয়ে হাঁটা শুরু করি। তুমুল বৃষ্টিতে কোমরপানি ডিঙিয়ে কাকভেজা হয়ে বাসায় আসি।

তিনি আরও বলেন, একদিকে এখন ভরা বর্ষার সিজন। তারমধ্যে টানা বৃষ্টির সাথে জোয়ারের পানি চলে আসায় পানির উচ্চতা আরও বেড়ে যায়। এখন কাকে দোষ দিবেন। কাউকে দোষ দেওয়ার আগে আমাদের সচেতন হতে হবে, তারপর সংশ্লিষ্টদের দোষ দিতে পারবো। যতদিন জলাবদ্ধতা পুরোপুরি নিরসন হবে না, ততদিন আমরা সাধারণ মানুষদের ভোগান্তি পোহাতে হবে।

এদিকে পানি থেকে কাঠ কুড়াতে থাকা এক কাঠ ব্যবসায়ীকে দেখা গেল চিৎকার করতে। তিনি বলেন, কয়েক ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে কপাল পুড়েছে। লাখ টাকার কাঠ পানিতে ভেসে গেছে। এই ক্ষতি আমাকে কে পুষিয়ে দিবে?

পাশে থাকা এক অটোরিকশা চালক বলেন, একটু অসুস্থ বোধ করার কারণে সকাল থেকে গাড়ি নিয়ে বের হতে পারিনি। সন্ধ্যার পর গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার পর থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। একটা ভাড়া নিয়ে নতুন ব্রিজ থেকে জিইসি যাচ্ছিলাম। মুরাদপুর থেকে কষ্ট করে দুই নাম্বার গেইট এসে মাঝ রোডে গাড়িটি বন্ধ হয়ে যায়। এক ঘণ্টা ঠেলে গাড়িটা কোনোভাবে পানি থেকে তুলেছি।

তিনি আরও বলেন, এখন গাড়ি চালু করতে পারছি না। সারারাত গাড়ি নিয়ে এখানে বসে থাকতে হবে। পানি নেমে যাওয়া পর্যন্ত। বড়লোকরা ভালো ভালো খাবার খেয়ে এসি রুমে আরাম করছে। আর এদিকে আমাদের গরিবের খবর কেউ রাখে না বাবা।

কক্সবাজার থেকে অসুস্থ বাবাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা অ্যাম্বুলেন্সের এক যাত্রী আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, বাবার অবস্থা খারাপ হওয়া। ডাক্তার কক্সবাজার মেডিকেল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাবাকে রেফার করে। দুই নাম্বার গেইট আসার পর অ্যাম্বুলেন্সটি বন্ধ হয়ে যায়। আধাঘণ্টা চেষ্টা করেও গাড়ি চালু না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত রিকশা করে বাবাকে মেডিকেলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু এখনও একটা রিকশাও পাচ্ছি না। বিপদ আসলে সব দিক থেকে আসে। সব কপাল ভাই।

এএইচ/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!