চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর সঙ্গে বাড়ছে শ্বাসকষ্ট, রোগীর চাপ সইতে পারছে না চট্টগ্রাম মেডিকেলের শিশু ওয়ার্ড

একদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর ভিড়, অন্যদিকে জ্বর, টাইফয়েড, শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য রোগীতে ঠাসা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল। মূলত ঋতু পরিবর্তনজনিত কারণেই ‘ভাইরাল ফিভারে’ রোগীরা আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

সরেজমিনে চমেক হাসপাতালের মেডিসিন ও শিশু বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, হাসপাতালের ১৪ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডের দ্বিতীয় ইউনিটে ৫ দিন ধরে ভর্তি আছেন আনোয়ারা থেকে আসা শফিকুর রহমান। তীব্র জ্বরে ভুগছেন তিনি। পরে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে জানতে পারেন তাঁর টাইফয়েড হয়েছে।

বোয়ালখালী থেকে পুলন দাশ নামে একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩ দিন ধরে ভর্তি আছেন একই ওয়ার্ডের ডেঙ্গু কর্নারে। ওয়ার্ডটির প্রতিটি শয্যায় এখন ডেঙ্গুর পাশাপাশি টাইফয়েড, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, কাশিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর চাপ। শুধু ১৪ নম্বর ওয়ার্ড নয়, মেডিসিন বিভাগের ১৩ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরেও একই চিত্র দেখা যায়।

অনেকেই আবার শয্যা সংকটে ওয়ার্ডের ফ্লোরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া ওয়ার্ডের ভেতর ও বাইরের বারান্দায়ও রয়েছে রোগীর চাপ।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চমেক হাসপাতালের ১৪ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডের (ইউনিট–২) ভারপ্রাপ্ত ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডা. মো. দেলোয়ারুল ইসলাম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, মূলত ঋতু পরিবর্তনের কারণে মানুষ এখন ‘ভাইরাল ফিভারে’ আক্রান্ত হচ্ছে। যে কারণে মেডিসিন ওয়ার্ডগুলোতে রোগীর চাপ বেড়েছে। এছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও কমছে না। আমাদের ডেঙ্গু কর্নারে প্রতিদিন নতুন রোগী আসছে। ডেঙ্গু ছাড়াও এখানে ভর্তি হওয়া অধিকাংশ রোগীই জ্বর, টাইফয়েডসহ ঋতু পরিবর্তনজনিত নানা রোগে আক্রান্ত।

ডেঙ্গু প্রসঙ্গে ডা. মো.দেলোয়ারুল ইসলাম বলেন, আজকেও আমাদের হাসপাতালে ১৬ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। আগে থেকে ৩৫ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের মধ্য আগের চেয়ে বেশি জটিলতা দেখা যাচ্ছে। শীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকার কথা না, কিন্তু এখনও ডেঙ্গু বাড়ছেই। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে সাত দিনের বেশি জ্বর হয় না। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে ১০ থেকে কারো কারো ১৪ দিন পর্যন্ত জ্বর থাকছে।

তিনি বলেন, মূলত জ্বর হলেই রোগীদের ডেঙ্গু টেস্ট করা উচিত। ওই সময়ে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী তরল খাবার খেতে হবে, না হয় ডেঙ্গু জটিল আকার ধারণ করতে পারে। মূলত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এবার যারা মারা গেছে তার বেশিরভাগেরই এক্সপান্ডেট ডেঙ্গু সিনড্রোম হয়ে মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ যখন ডেঙ্গুর পাশাপাশি শরীরের অন্যান্য যেমন মস্তিষ্ক, লিভার, ফুসফুসে এটি ছড়িয়ে যায় সেক্ষেত্রে রোগী শক হয়ে মারা যায়।

রোগীদের পরামর্শ দিয়ে ডা. মো. দেলোয়ারুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গুর পাশাপাশি ঋতু পরিবর্তনের কারণে বেশি জ্বর হচ্ছে। এ সময় প্রথমেই অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে জ্বর বেশিদিন হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। ভাইরাস জ্বর হলে প্রচুর পানি পান করতে হবে এবং সেইসাথে পুষ্টিকর খাবার জরুরি। এখন ঘরে ঘরে জ্বর-স্বর্দি, তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, শুধু মেডিসিন ওয়ার্ডে নয়, হাসপাতালের ৯ নম্বর শিশু ওয়ার্ডেও এখন ঠাঁই নেই। ওয়ার্ডটির সবকটি শয্যা ছাড়িয়ে ফ্লোরেও শিশুদের চিকিৎসা চলছে। শয্যা সংকটে কোনো কোনো শয্যায় একাধিক রোগীকে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। এছাড়া শিশু ওয়ার্ডের ডেঙ্গু ব্লকেও ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বেড়েছে। মাত্রাতিরিক্ত জ্বর, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, ডেঙ্গু, ডায়রিয়াসহ নানান জটিলতা নিয়ে ভর্তি হচ্ছে শিশুরা।

জুরাইন নামে ৩ মাসের শিশুকে নিয়ে পটিয়া থেকে এসেছেন তার মা। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে কাতরাচ্ছে শিশুটি।
এদিকে চন্দনাইশ থেকে আসা হাসেনা আক্তার বলেন, আমার ছেলের বয়স ১০ বছর। আজকে ৫ দিন ধরে প্রচণ্ড জ্বর ও শ্বাসকষ্ট। সেজন্য হাসপাতালে ভর্তি করেছি।

এমন অসংখ্য রোগী এখন শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। রোগীর চাপ বেড়েছে আগের চেয়ে চারগুণ। মাত্রাতিরিক্ত রোগীর চাপে ওয়ার্ডে হাঁটাচলারও সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া অধিক রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ৬৪ শয্যার ৯ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে প্রতিদিন গড়ে রোগী আসছে একশ’রও বেশি।

যোগাযোগ করা হলে শিশু ওয়ার্ডের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. রেজাউল করিম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমাদের এখানে এখন ধারণক্ষমতার চারগুণ রোগী রয়েছে। বেশিরভাগই শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ। নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বেশি। আমাদের দুটো ওয়ার্ড আছে, ৮ এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ড। নবজাতক ছাড়া এক মাস বয়স থেকে ১২ বছর বয়সের গড়ে ৪০০ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন ওয়ার্ডগুলোতে। এছাড়া প্র‍তিদিন গড়ে অন্তত ১০০ রোগী ভর্তি হচ্ছেন।

তিনি বলেন, যেহেতু শীত আসছে তাই ঋতু পরিবর্তনের কারণে শিশুরা অসুস্থ হচ্ছে। শ্বাসকষ্ট, কাশি, জ্বর হলে প্রথমেই স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে নেওয়া উচিত। নিজেরা ফার্মেসিতে গিয়ে পাওয়ারফুল অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো কিংবা ভুল চিকিৎসায় রোগীর অবস্থা জটিল হয়ে উঠতে পারে।

শিশুর বয়স এক বছরের নিচে, তার যদি বুকের খাঁচাটা ৫০ বারের বেশি ওঠানামা করে বা মিনিটে ৫০ বারের বেশি শ্বাস নেয়, তাহলে নিউমোনিয়া তৈরি হয়। বয়স এক বছরের ওপরে হলে মিনিটে যদি ৪০ বারের বেশি শ্বাস নেয়, তাহলে শিশুকে দ্রুত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া উচিত। পরবর্তীতে পরিস্থিতি বিবেচনায় হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেবেন চিকিৎসক। যেহেতু এখন সিজন পরিবর্তন হচ্ছে তাই শিশুদের প্রতি মায়েদের বিশেষ যত্ন নিতে হবে— যোগ করেন তিনি।

এসআই/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!