ইপিজেডের ‘সেই কলোনিই’ অপরাধের স্বর্গ, এক পরিবারের হাতে নিয়ন্ত্রণ

নগরের ঘনবসতি ও ব্যস্ততম এলাকা ইপিজেড। সেই এলাকার বেপজা গেট এলাকার রেলবিট সংলগ্ন এক কলোনিই অপরাধের স্বর্গ। মাদক, পতিতাবৃত্তি, অপহরণ— হেন কোনো অপরাধ নেই এখানে হয় না। আর সবকিছুই চলছে রেলের জায়গা দখল করে গড়ে ওঠা ঝন্টু মাঝির কলোনি ঘিরে।

অপরাধের সেই ‘স্বর্গ’ তৈরির কারিগর ঝন্টু মাঝি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। তাদের বিরুদ্ধে থানায় রয়েছে মাদক, অপহরণসহ একাধিক মামলা। গ্রেপ্তার হয়ে জেলও খেটেছেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু জামিনে বের হয়ে আবারও জড়িয়ে পড়েন অপরাধে।

অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় কাউন্সিলরের ছায়া রয়েছে ঝুন্টু মাঝির ওপর। একাধিকবার তাকে থানা থেকে ছাড়িয়েও নিয়েছেন তিনি। এছাড়া পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তাও অপরাধে জড়িত। এসব কারণে কাউকে পরোয়া করেন না ঝন্টু মাঝি।

স্থানীয়রা জানান, ঝন্টু মাঝির কলোনিতে সুন্দরী নারী দিয়ে দেহ ব্যবসা ও ইয়াবা বিক্রি ওপেন সিক্রেট। গার্মেন্টসে কর্মরত নারীদের অপরহণ ও আটকে রেখে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করার ঘটনাও ঘটেছে কলোনিতে। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করেন কলোনির মালিক ঝন্টু মাঝি, তাঁর বোন মালা বেগম ও বোনজামাই সাইফুল ইসলাম ওরফে সাইফুল।

থানা সূত্রে জানা গেছে, ঝন্টু মাঝি ও তাঁর বোন মালা বেগমের নামে ইপিজেড থানায় একাধিক মামলাও রয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঝন্টু মাঝিসহ পুরো পরিবার বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তাদের সব অপকর্ম চলে ওই কলোনিকে ঘিরে। সেখানে দেহ ব্যবসার খদ্দরের যোগান দেন ঝন্টু মাঝির ছোট বউ নুরজাহান ওরফে বিবি, শ্যালিকা জরিনা ওরফে শিল্পী এবং আবুল হোসেন নামের এক যুবক। এ ব্যবসার দেখভাল এবং মাদকসেবী ও খদ্দেরের কাছে ইয়াবা সরবরাহ করেন ঝন্টু মাঝির বোন মালা বেগম। সেখানে ইয়াবাসহ মাদকের যোগান দেন ঝন্টু মাঝি ও মালা বেগমের স্বামী সাইফুল ইসলাম ওরফে সাইফুল।

স্থানীয়রা জানান, ইতিপূর্বে সেই কলোনি থেকে ইয়াবাসহ ঝন্টু মাঝি ও মালা বেগমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের দু্জনের বিরুদ্ধে ইপিজেড থানায় মাদক আইনে দুটি মামলাও রয়েছে। এছাড়া একটি মেয়েকে আটকে রেখে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করায় মালা বেগমসহ নয়ন নামের আরেকজনের বিরুদ্ধে একই থানায় অপরহণ মামলা আছে। সেই মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব-৭।

জানা যায়, মাদক ও দেহ ব্যবসা করে ওষ্যা ফকির মাজার এলাকায় টিনসেড কলোনিসহ কলসিদীঘির পাড় এলাকায় তিনটি বিল্ডিং বন্ধকে নিয়েছেন ঝন্টু মাঝি ও মালা বেগম। ওষ্যা ফকির মাজার এলাকার ৯ তলা বিল্ডিয়ের তৃতীয় তলা এবং একই এলাকায় ঝন্টু মাঝির বন্ধক নেওয়া টিনসেড কলোনিতে মাদক ও দেহ ব্যবসার আলাদা দুটি স্পট চালু করেছে।

ইপিজেডের পোশাক কারখানায় কর্মরত হেমায়েত উদ্দিন নামের এক কর্মকর্তা বলেন, ৮ বছর ধরে আমি কলসিদীঘি এলাকায় বসবাস করছি। রেলবিটের ঝন্টু মাঝির কলোনিকে ঘিরে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে ইপিজেড পুলিশ ফাঁড়ির কয়েকজন তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন। তাই তারা বেপরোয়া। ঝন্টু মাঝি প্রায়সময় স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদের নাম ভাঙিয়ে চলেন। তাই তার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস কেউ করে না।

সাইফুল ইসলাম নামের এক বাসিন্দা বলেন, মালা বেগম ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়ে জেলে থাকাকালীন কলোনিতে তালা ঝুলিয়েছিল ইপিজেড পুলিশ ফাঁড়ি। পরে তিনি জেল থেকে বের হয়ে আবার কীভাবে কলোনির তালা খুলে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে তা কারো বোধগাম্য নয়।

তিনি বলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মালা বেগম ও তার স্বামী সাইফুল কলোনির অপর পাশে একটি চায়ের দোকানে বসেন। দোকানটি তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। সেখান থেকে কলোনিতে খদ্দের পাঠানো এবং মাদকসেবীদের ইয়াবা বিক্রি করেন দুজন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এক যুগেরও বেশি সময় আগে ঝন্টু মাঝির কলোনি হিসেবে পরিচিত রেলের জায়গা দখল করেন স্থানীয় দিদার নামের এক লোক। পরে সেই জায়গা ভাড়ায় নিয়ে বাঁশের বেড়া দিয়ে দোতলা ঘর নির্মাণ করেন ঝন্টু মাঝি। এরপর উপরে জুয়ার আসর ও নিচে চলত ক্যারাম খেলা। টানা পাঁচ থেকে ছয় বছর এভাবে চলতে থাকে। একপর্যায়ে প্রশাসনের কড়াকড়িতে তা বন্ধ হয়।

পরে বেড়ার ঘর ভেঙে ওই জায়গায় দুউনিটের একটি সেমিপাকা ঘর নির্মাণ করা হয়। এক ইউনিটে বড় বউ এবং অপর ইউনিটে ছোট বউ নুরজাহান ওরফে বিবিকে থাকতে দেন। নুরজাহানকে দেওয়া ইউনিটে শুরু হয় দেহ ব্যবসা। সেই থেকে আজও এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন ঝন্টু মাঝি। সাড়ে তিন বছর আগে ঝন্টু তার আপন বোন মালা বেগমকে দিয়ে শুরু করেছিলেন ওই ব্যবসা। একপর্যায়ে তারা কলোনিতে ইয়াবা বিক্রি শুরু করেন।

আরও জানা গেছে, বছর দুয়েক আগে রেলবিট এলাকা থেকে ইয়াবাসহ ঝন্টু মাঝিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় প্রায় ৬ মাস জেলও খাটেন তিনি। এরপর বছরখানেক আগে একটি মেয়েকে আটক রেখে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করায় নয়ন নামের এক যুবকসহ মালা বেগমকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। সেই মামলায় প্রায় ৭ মাস জেল খাটেন মালা। পরে জামিনে বের হয়ে আবারও একই কাজে জড়িয়ে পড়েন।

চার-পাঁচ মাস আগে ১০০ পিস ইয়াবাসহ মালাকে গ্রেপ্তার করে ইপিজেড থানা পুলিশ। এ ঘটনায় প্রায় তিন মাস জেলে ছিলেন তিনি। পরে জামিনে বের হয়ে আবারও আগের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। এখন মালার সঙ্গী স্বামী সাইফুল ইসলাম ওরফে সাইফুল। মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে বিভিন্ন জায়গায় ইয়াবার চালান পাঠান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদ আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ঝন্টু মাঝির কলোনিতে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড চলার কথা সঠিক। কলোনিটা উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেখানে রাস্তা হবে।

ঝন্টু মাঝির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন কাউন্সিলর। তবে পুলিশের কাছ থেকে তাকে একাধিকবার ছাড়িয়ে নিয়েছেন বলে স্বীকার করেন কাউন্সিলর গোলাম মোহাম্মদ।

এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল করিম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমি আসার পর থেকে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। সেখানে আমরা একাধিকবার অভিযান চালিয়েছি। কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছি। কিন্তু তারা জামিনে বের হয়ে পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পরে।

ওসি আরও বলেন, পুলিশের একার পক্ষে এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব নয়। স্থানীয় কাউন্সিলর ও রাজনীতিবীদদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তবুও আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে।

আরবি/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!