পতেঙ্গায় ইজিবাইক ঘিরে চাঁদাবাজি, গিলছে বিদ্যুৎ—রাস্তায় নামলেই চাঁদা

চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর-পতেঙ্গা এলাকায় বিদ্যুৎচালিত অবৈধ ইজিবাইক (টমটম) থেকে চাঁদা তুলতে এবার তৈরি করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ অটোরিকশা-অটোটেম্পু শ্রমিক ফেডারেশন’। এতোদিন এসব অবৈধ গাড়ি চলাচলে ট্রাফিক পুলিশের কড়াকড়ি থাকলেও সম্প্রতি স্থানীয় চাঁদাবাজরা সংগঠনটি তৈরি করে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। আর এই সংগঠনের নামেই প্রতিদিন তোলা হয় চাঁদা।

ট্রাফিক পুলিশ জানায়, সংগঠনটির আদালতের আর্ডার কপি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। অর্ডারে অবৈধ এসব ইজিবাইক ও অটোরিকশা চালানোর বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা নেই।

আরও পড়ুন: হালিশহরে ৩১ স্পটে চার্জ নামে চাঁদাবাজি, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারি রিকশা

অভিযোগ আছে, গত এক বছর যাবৎ অবৈধ টমটম বন্দর-পতেঙ্গা প্রায় বন্ধ ছিল। অনেকে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে অভ্যন্তরীণ সড়কে টমটম চালালেও কাউকে চাঁদা দিতে হয়নি। কিন্তু ‘বাংলাদেশ অটোরিকশা-অটোটেম্পু শ্রমিক ফেডারেশন’ নামের সংগঠন গঠনের পর প্রতিদিন দিতে হচ্ছে চাঁদা। ইতোমধ্যে পতেঙ্গার ছয়টি লেইন (সড়ক) থেকে এই সংগঠনের নামে এককালীন তিন লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়েছে। এছাড়া সংগঠনটির ‘স্টিকার’ দিয়ে প্রতি ইজিবাইক থেকে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে বিভিন্ন সড়কে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুসলিমাবাদ সড়কের একাধিক টমটম চালক জানান, গত একবছর অভ্যন্তরীণ সড়কে তারা ইজিবাইক চালিয়েছেন। গত কয়েকদিন ধরে সড়কগুলোতে কিছু লোক সিন্ডিকেট করে স্টিকার দিয়ে চাঁদা আদায় করছে। প্রতি গাড়িতে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা করে চাঁদা দাবি করছে তারা। মুসলিমাবাদ সড়কে খলিল, নুরুল আবছার, আলী আকবর ও কামালরা আমাদের থেকে জোর করে টাকা আদায় করছেন।

‘বাংলাদেশ অটোরিকশা-অটোটেম্পু শ্রমিক ফেডারেশন’ নামের সংগঠনটির আহ্বায়ক আব্দুর রহমান, উপদেষ্টা মো. সালামত আলী, মো. ছিদ্দিক মিয়া, সদস্য সচিব ওসমান গনি। তারা আদালতের পিটিশনের (রিট নম্বর ৬৭২০/২০২২) দোহাই দিয়ে এসব অবৈধ গাড়িকে বৈধ করার চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যে তারা কাটগড়-কন্ট্রোল মোড় (‘এ’ লেন) সড়কে মাসুদ, কাটগড়-নাজিরপাড়া (‘বি’ লেন) সড়কে মাইনুল, ওয়াহিদ মাস্টার ও আবু তাহের, কাটগড়- মুসলিমাবাদ (‘এমবি’ লেন) সড়কে খলিল ওরফে খইল্যা ডাকাত, নুরুল আবছার ও কামাল, স্টিলমিল হাউজিং কলোনি (‘ডি’ লেন) সড়কে সাইফুদ্দিন ওরফে শাহাব উদ্দিন (কাউন্সিলর বারেকের পিএ) এবং স্টিলমিল টিএসপি (‘সি’ লেন) সড়কে রিপনকে নিয়ে স্থানীয়ভাবে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এদের কাছ থেকে প্রতি লেনে ৫০ হাজার টাকা করে এককালীন মোট ৩ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়েছে।
জানা গেছে, পতেঙ্গা-ইপিজেড এলাকায় ছয়টি সড়কে প্রায় একযুগ ধরে চলছে অবৈধ ইজিবাইক। শুরু থেকেই এসব গাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করে আসছিল স্থানীয় চাঁদাবাজরা। প্রতিটি সড়কে আলাদা আলাদা সিন্ডিকেট করে সক্রিয় ছিল তারা। গত এক বছর সিএমপির ট্রাফিক বন্দর বিভাগ এসব অবৈধ গাড়ির বিষয়ে কঠোর অবস্থানে গেলে অনেকটা নিষ্ক্রিয় ছিল চাঁদাবাজরা।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, দেশে বিদ্যুৎ সংকটের এই সময়ে পতেঙ্গা এলাকার অভ্যন্তরীণ প্রতিটি সড়কে চলছে অবৈধ ইজিবাইক। কাটগড়-মুসলিমাবদ সড়কে চলাচল করা ইজিবাইকগুলোর সামনের গ্লাসে ‘বাংলাদেশ অটোরিকশা-অটোটেম্পু শ্রমিক ফেডারেশন’ নামে একটি সংগঠনের স্টিকার লাগানো রয়েছে। ড্রাইভারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব স্টিকার নিতে স্থানীয় খলিল ওরফে খইল্যা ডাকাত, নুরুল আবছার ও কামালদের দিতে হয়েছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। কেউ স্টিকার না নিলে গাড়ি নিয়ে সড়কে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না।
স্থানীয়রা জানান, বন্দর-পতেঙ্গা একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা। এখানে চট্টগ্রাম ইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেডসহ পদ্মা, মেঘনা, যমুনা মতো অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। দেশে বিদ্যুৎ সংকট কারণে এমনিতেই দৈনিক কয়েক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে থাকে এলাকার মানুষ। এরমধ্যে বিদ্যুৎচালিত এসব অবৈধ ইজিবাইকে চার্জ দিতে ১২টির মতো গ্যারেজ রয়েছে। সেখানে অনেক গ্যারেজ মালিক অবৈধভাবে বিদ্যুতের লাইনও ব্যবহার করে। ফলে চাঁদাবাজির পাশাপাশি এখন বিদ্যুতের ব্যাপক ভোগান্তিতেও পড়ছেন এলাকাবাসী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্যারেজ মালিক বলেন, ‘পতেঙ্গার ছয়টি সড়কে প্রায় হাজারখানেক ইজিবাইক চলে। প্রতিদিন দুই শিফটে একটি টমটমে ১০ থেকে ১১ ইউনিট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। প্রতিটি ইউনিটে এক হাজার ওয়ার্ডের একটি যন্ত্র এক ঘণ্টা চালালে এক ইউনিট হয়। সে হিসেবে পতেঙ্গার হাজার ইজিবাইকের প্রতিদিন ১১ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যয় হয়।
অভিযোগের বিষয় বাংলাদেশ অটোরিকশা-অটোটেম্পু শ্রমিক ফেডারেশনের সদস্য সচিব মো. ওসমান ওসমান গনি বলেন, ‘আমরা ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা চালানোর ব্যাপারে আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেছি। আদালত অভ্যন্তরীণ সড়কে এসব গাড়ি চালানো যাবে বলে রায় দিয়েছেন। এ বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে আমরা বসেছি, প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেছি। তবে কারও থেকে আমরা এককালীন চাঁদা আদায় করিনি। কাউকে স্টিকার দিয়ে টাকা নিতেও বলিনি। তবে পুলিশ অনুমতি দিলে সদস্যরা সংগঠনকে মাসিক চাঁদা দিয়ে গাড়ি চালাতে পারবে।’

আরও পড়ুন: ‘অবৈধ’ বিয়ের ফাঁদ পেতে চাঁদাবাজি, হালিশহরের পুলিশ ধরল ২ যুবককে

তবে নিউমুরিং বিদ্যুৎ অফিসের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. গিয়াস উদ্দিন আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ‘এসব গাড়িপ্রতি দৈনিক ১৪ ইউনিটের মতো বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। পতেঙ্গা এলাকায় যেসব গ্যারেজ রয়েছে তাদের বাণিজ্যিক মিটার রয়েছে। এসব গ্যারেজের কেউ চোরা লাইন ব্যবহার করছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। তবে এখন থেকে নিয়মিত তদারকি করা হবে।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক বন্দর) শাকিলা সোলতানা আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ‘বাংলাদেশ অটোরিকশা-অটোটেম্পু শ্রমিক ফেডারেশন নামে সংগঠনটি আদলতের একটি কপি আমাদেরকে দেখিয়েছে। তাদের ইজিবাইক চালানো কোনো অনুমতি এখনো দেওয়া হয়নি। আমরা রায়ের কপি বিআরটিএ কর্তৃপক্ষকে পাঠিয়েছি। তবে রায়টির ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ হচ্ছে। রায়ের কপিটিতে ব্যাটারিচালিত অবৈধ এসব গাড়ির বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই।’
আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!