অ্যাডভোকেট ফয়জুর রহমান ও লাকি সেভেনের ‘শেখ’ হওয়ার গল্প

আলোকিত এক মানুষ ‘অ্যাডভোকেট ফয়জুর রহমান’। বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নির্মোহ এই মানুষটির নাম। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ— ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে যুক্ত ছিলেন তিনি।

কঠিন সময়েও অ্যাডভোকেট ফয়জুর রহমান আঁকড়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিনই ছিলেন আওয়ামী লীগের পতাকাতলে। সামরিক শাসনামলে অনেক লোভ দেখিয়েও তাকে বিচ্যুত করা যায়নি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে।

১৯৩৩ সালের ৬ আগস্ট চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলায় জন্ম ফয়জুর রহমানের। কথায় আছে— কিছু মানুষ বিশেষ গুণ নিয়ে জন্ম নেয়। অ্যাডভোকেট ফয়জুর রহমানের ক্ষেত্রে কথাটা শতভাগ সত্য।

সংগ্রামী চেতনা নিয়েই জন্মেছিলেন ফয়জুর রহমান। শৈশব থেকেই পড়ালেখার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। এ কারণে সবার চোখে আলাদা  জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি।

চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মেজ। ছোট্ট কাঁধে পুরো পরিবারের বিশাল দায়িত্ব নেওয়ার ইতিহাস ফয়জুর রহমানের জীবনীতেই পাওয়া যাবে। আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন ছিল তার, এ কারণে তিনি সমাজে হয়ে উঠেছিলেন অনন্য।

ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সরব ছিলেন তিনি। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ৬৬’র  ছয়দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ— সবখানেই তিনি ছিলেন সক্রিয় ভূমিকায়।

আরও পড়ুন: চলে গেলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর অ্যাডভোকেট ফয়জুর রহমান

শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অ্যাডভোকেট ফয়জুর রহমান। ১৯৬৫ সাল থেকে দীর্ঘদিন (তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগ) দক্ষিণ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন।

নিজের পাশাপাশি পরিবারকেও আলোকিত করেছেন ফয়জুর রহমান। ব্যক্তিগত জীবনে ৭ সন্তানের জনক তিনি। সাত; ইংরেজিতে সেভেন। সেভেনকে আবার লাকি ধরা হয়। এই ‘লাকি’ শুধু কথাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সত্যিকার অর্থেই ফয়জুর রহমানের কাছে ছিল সাতটি হীরা।

ফয়জুর রহমানের সাত সন্তানই আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। কেউ ডাক্তার, তো কেউ ব্যাংকার; আবার একজন তো নিজেকে নিয়ে গেছেন ‘বিচারপতি’র মতো অনন্য উচ্চতায়। আর তাঁদের মা, অ্যাডভোকেট ফয়জুর রহমানের সহধর্মিনী হোসনে আরা বেগম পেয়েছেন ‘রত্নগর্ভা’ মায়ের সম্মাননা।

জীবনভর বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল ছিলেন ফয়জুর রহমান। একটা গল্প বললেই বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার হবে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণেই ফয়জুর রহমান নিজের সন্তানদের নামের আগে যুক্ত করে দিয়েছিলেন ‘শেখ’ শব্দটি। তখনকার সময়ে এটি ছিল বিরল এক ঘটনা।

১৯৬৯ সালে চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট ফয়জুর রহমান (দাঁড়ানো, বাঁ থেকে দ্বিতীয়)

১৯৭০ সালের ২৬ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দক্ষিণ চট্টগ্রাম আসেন। ওইসময় বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে যে কমিটি গঠন করা হয়ে সেই কমিটির সভাপতিও ছিলেন অ্যাডভোকেট ফয়জুর রহমান।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। চট্টগ্রামের বান্দরবানে নিজের জায়গায় ঘর বানিয়ে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের টাকা-পয়সা-রসদ দিয়ে প্রতিনিয়ত সাহায্য করেছিলেন তিনি।

সাফল্য কিংবা অর্জনের পাশাপাশি বঞ্চনার গল্পও আছে ফয়জুর রহমানের। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম–১৩ আসনে জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে তাকে প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন দিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু শেষমুহূর্তে এসে অজ্ঞাত কারণে তা বদলে যায়। এতে হতাশ হয়েছিলেন আজীবন আওয়ামী লীগের পতাকাতলে থাকা এ ত্যাগী নেতা। যিনি কিনা ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্য এবং চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের খাদ্য, কৃষি ও সমবায়, ত্রাণ, পুনর্বাসন কমিটির উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্য ছিলেন।

আরও পড়ুন: মামলা নিষ্পত্তিতে রেকর্ড গড়লেন বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের নেতৃত্বে হাইকোর্ট বেঞ্চ

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর সামরিক লোকজন খুঁজতে থাকে ফয়জুর রহমানকে। জেনারেল জিয়া এবং এরশাদ আমলে রাজনৈতিক ও প্রশাসনের বিভিন্ন লোভনীয় পদের প্রস্তাব দেওয়া হয় তাকে। তবে এসব প্রলোভনে কখনো পা বাড়াননি তিনি। সংকটময় সব পরিস্থিতিতেই সঙ্গে থেকেছেন আওয়ামী লীগের। শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষক এবং উপদেষ্টা হিসেবেও।

চলতি বছরের ২৭ জুন পৃথিবীকে বিদায় জানান প্রবীণ এই আইনজীবী। গুণী এই মানুষটির স্মরণে আগামীকাল (১৯ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত হচ্ছে নাগরিক শোকসভা। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে সকাল ১১টায় শুরু হবে এ আয়োজন। নাগরিক শোকসভা কমিটির এ আয়োজনে প্রধান অতিথি থাকবেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি। শোকসভা কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছেন অ্যাড. ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল এবং সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসেন।

এআইটি/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!