৮ দাবিতে অনড় হিন্দুরা, চট্টগ্রামের জনস্রোত থেকেই ঢাকায় লং মার্চের ঘোষণা

চট্টগ্রামে এখন আলোচনার কেন্দ্রে সনাতন জাগরণ মঞ্চের সমাবেশ। ৮ দফা দাবি আদায়ে সংগঠনটি বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় মহাসমাবেশ করবে। একইসঙ্গে ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা অভিমুখে লং মার্চের।

শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) দুপুর ৩টায় নগরের ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠে সেই সমাবেশে ছিল জনস্রোত। সমাবেশের বিস্তারিত নিয়েই এ প্রতিবেদন।

৫ আগস্ট পরবর্তী দেশব্যাপী হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা, নির্যাতন-নিপীড়ন, মঠ-মন্দিরে ভাঙচুর, জায়গা-জমি জবরদখল, খুন-ধর্ষণের প্রতিবাদে ও ৮ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ও পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী।

আরও পড়ুন : আমার মাটি আমার মা, বাংলাদেশ ছাড়ব না

এদিকে সমাবেশ শুরুর আগে থেকে সনাতনীরা ভিড় করতে থাকে লালদীঘি মাঠে। এসময় হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন মিছিল নিয়ে স্লোগানে স্লোগানে সমাবেশে আসতে থাকে। লালদীঘির মাঠ ও আশপাশসহ বক্সিবিট, কে সি দে রোড, জেল রোড, কোতোয়ালি মোড়ে ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়। সমাবেশে আসা বিভিন্ন নারী-পুরুষের হাতে ছিল বিভিন্ন দাবি সম্বলিত ব্যানার–ফেস্টুন।

এসময় ‘আমার মাটি আমার মা, বাংলাদেশ ছেড়ে যাব না’, ‘কথায় কথায় বাংলা ছাড়, বাংলা কি তোর বাপ-দাদার, ‘সনাতনী হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘জেগেছে রে জেগেছে, সনাতনী জেগেছে’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেওয়া হয়।

অন্যদিকে সমাবশ ঘিরে ছিল সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব ও ডিবিসহ প্রশাসনের বড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

সমাবেশে মুখপাত্র ও পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী বলেন, আপনারা আমাদের যত বেশি নির্যাতন করবেন, আমরা তত বেশি ঐক্যবদ্ধ  হবো। আমাদের এই ঐক্যকে কোনোভাবেই বিভক্ত করতে পারবেন না। এই ঐক্য বাংলার অস্তিত্বের ঐক্য, এই ঐক্য অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনিমার্ণের ঐক্য, এই ঐক্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে শুরু করে বাংলার কৃষ্টি কালচারের ঐক্য। এই ঐক্যকে কোনোভাবেই খণ্ডিত করা যাবে না।

আরও পড়ুন :দেশজুড়ে হামলা-নির্যাতন, প্রতিবাদে চেরাগী চত্বরে লাখো হিন্দুর ঢল

৫ সদস্যের উপদেষ্টা সংসদ এবং ১৯ জনের সমন্বয়ক পরিষদ গঠন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটি আমাদের আন্দোলনের সুফল। এতদিন আমাদের অভিভাবক ছিল না। মস্তকবিহীন শরীর নিয়ে আন্দোলন করছিলাম। আজকে আমাদের মাথায় ছাতা এসেছে। ভয়ের কোনো কারণ নেই। আপনারা সবাই জেগে উঠুন। একটা জিনিস মনে রাখবেন, যারা দুর্বলতা লালন করে তারা সাধু হতে পারে না। যারা সনাতনী তারা সর্বদাই সাহসী। যারা বেদের অনুগামী তাদের ভয় নেই, মৃত্যু নেই। আমরা ভূমিপুত্র, আমরা উড়ে আসিনি। আমাদের উৎখাত করার চিন্তা করবেন না।

তিনি বলেন, যদি এই দেশ থেকে আমাদের উচ্ছেদ করে কেউ শান্তিতে থাকতে চান, তাহলে এটা সাম্প্রদায়িকতার অভয়ারণ্য হবে। এটা আফগানিস্তান-সিরিয়া হবে। বাংলাদেশ কোনো গণতান্ত্রিক শক্তির রাজনীতি করার সুযোগ থাকবে না। আজকে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হচ্ছে বারবার। দেশে স্থিতিশীলতা আসছে না। কারণ সহনশীলতা লুপ্ত হচ্ছে, সম্মানবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। যে শিক্ষকরা জাতির মেরুদণ্ড তাদের অসম্মান করা হচ্ছে। শুধুমাত্র সংখ্যালঘু পরিচয়ে ৯৩ জন হিন্দুকে পুলিশের চাকরি থেকে অব্যাহিত দেয়া হয়েছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভেটেরিনারি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দুদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। মাঝখানে কিছুদিন থেমে গিয়েছিল। আবার নতুন করে মাথা ছাড়া দিচ্ছে। এরকম পরিস্থিতি বাংলার জনগোষ্ঠী কোনো মুক্ত মনার মানুষ সহ্য করতে পারে না। এই সংস্কৃতিকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। আমরা আর ঘুমিয়ে থাকব না। আমরা মাঠে নেমেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত আট দফা দাবি প্রতিষ্ঠিত না হবে আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি মৃত্যু হলেও রাজপথ ত্যাগ করবো না।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী বলেন, যারা এই আন্দোলনে যুক্ত তাদের বেছে বেছে মামলার আসামি করা হচ্ছে।  কেউ যদি রাজনীতি দুর্বৃত্তপরায়নের যুক্ত থাকে তাদের বিচার করুন। তাদের আসামি করুন, আমরা বিরোধিতা করব না। কিন্তু  যারা রাজনীতি করে না, স্বধর্মের অস্তিত্বের জন্য লড়াই করছে  মানবতার কথা বলছে, তাদেরকে মামলার আসামি করা হচ্ছে। এই প্রবণতা বন্ধ না করলে কখনো একটি সহনশীল, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। সুতরা আমাদের বাদ দিয়ে কোনো রাষ্ট্রযন্ত্র বিনির্মাণের প্রচেষ্টা আপনারা কখনো করবেন না।

তিনি বলেন, পাকিস্তানে ৫৪ সালে আমাদের ২৮ শতাংশ অনুযায়ী সংসদীয় আসন ছিল ৭০টি। আজকে হিন্দুদের জন্য একটা সংসদীয় আসন নোই। আমাদের আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি, বিভিন্ন দলীয় পরিচয়ে নমিনেশন দিয়ে দলীয় চাকরে পরিণত করছে। এমন বাস্তবতায় আমাদের সংখ্যানুপাতিক হারে সংসদীয় আসন বরাদ্দ করতে হবে। আমরা এই দেশে ৩২-৩৩টা আসন পায়। সেখানে আমাদের মুলা ঝুলানোর রাজনীতি করে দাবিয়ে রাখবে না। এরকম যদি হয় আমরা দেশে ভোট বর্জন করবো। কিন্তু আমরা গণতন্ত্রের নামে প্রহসন মেনে নেব না।

সংখ্যালঘু আইন ও কমিশনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের তথাকথিত মানবতাবাদীরা, জাতীয়তাবাদীরা বলেন, আপনারা বাংলাদেশের নাগরিক। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যেই আপনারা থাকবেন। আরে ভাই, ৫৬০টি মসজিদ হয়েছে। একটি মন্দির কি এই জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা পেতে পারি না? বরাদ্দ নিয়ে প্রহসন চলছে। ১৫ হাজার কোটি টাকা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বরাদ্ধের মাত্র ২০০ কোটি মতো তিন ধর্মাবলম্বীদের জন্য?’  তাহলে এটি কী প্রহসন নয়? বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে এই সংবিধান সংশোধনকে মানবো না।

তিনি আরো বলেন, এই আন্দোলনকে কোনোভাবেই আমরা হারিয়ে যেত দেব না। আমরা এরপরে রংপুরে, খুলনাতে, বরিশালে এবং প্রতিটি বিভাগীয় শহরে মহাসমাবেশ ঘোষণা করছি। সেখান থেকে প্রতিটি জেলায় জেলায় সমাবেশ হবে এবং জেলা থেকে উপজেলায় যাব। এরপর আমরা ঢাকামুখী লংমার্চ করব।

চিন্ময় ব্রহ্মচারী বলেন, আমাদের এই আন্দোলন সুশৃঙ্খল আন্দোলন, কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। হিন্দু কিছু বললে রাজনৈতিক ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা করে। একটি তথাকথিত পত্রিকায় বলা হচ্ছে এটি ইসকনের সমাবেশ। কিন্তু এটি ইসকনের নয়, সনাতনীদের সমাবেশ। এই সমাবেশে নাকি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ এসেছে  এরকম প্রপাগন্ডা করা হয়েছে। এর আগেও চেরাগী নিয়ে একইরকম রিপোর্ট করেছে। কিন্তু সরকারের কোনো এজেন্সির এই নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। আগে আমরা সুঙ্খলভাবে সভা-সমাবেশ করেছি। কিন্তু প্রতিবার রাজনৈতিক ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। হিন্দুদের আওয়ামী লীগের ট্যাগ দেওয়া পরিহার করুন।

আরও পড়ুন : চট্টগ্রামে মোমবাতি হাতে আলোর মিছিল

বক্তারা বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছরে সনাতনীরা শুধু অবহেলিত ছিল। সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু সনাতনীদের ভাগ্য বদলায় না। যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তারা সনাতনীদের দুঃখ-দুর্দশাকে লুকানোর চেষ্টা করে। সনাতনীদের সঙ্গে হওয়া অন্যায়-নির্যাতন লুকিয়ে স্বাভাবিকতার কথা বলে। গত ৫৩ বছরে এদেশে হওয়া হিন্দু নির্যাতন-খুনের কোনো বিচার হয়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধীরা বারবার এ ধরনের ঘটনায় উৎসাহিত হয়েছে। প্রতিবার ভোটপরবর্তী বা ক্ষমতার পালাবদলের সময় নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে হিন্দুদের ওপর। সেটা কেন হবে? কারা দোষী? কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত? তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হলে তো বেরিয়ে আসবে কারা সাম্প্রদায়িক ঘটনার সঙ্গে জড়িত? কেন সরকার সাম্প্রদায়িক ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করছে না।

বক্তারা আরো বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা ধন্যবাদ দিতে চাই। তারা দুর্গাপূজায় ১ দিন ছুটি বাড়িয়েছে। তবে সেটি পর্যাপ্ত নয়। আমরা চেয়েছি ৫ দিনের ছুটি। সেখানে ২ দিন ছুটি কেন? যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে এদেশের ছাত্র-জনতা প্রাণ দিয়েছে সেখানে আবার বৈষম্য হবে কেন? ক্ষতিগ্রস্ত সনাতনীদের ক্ষতিপূরণ এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সংস্কার করার কথা বলেছে সরকার। এটি খুবই ইতিবাচক। খুব দ্রুত এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। সরকার যদি ৮ দফা দাবি মেনে নেয় সনাতনীরা আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।

স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারীর সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন কৈবল্যধামের মোহন্ত মহারাজ কালীপদ ভট্টাচার্য, শংকর মঠ ও মিশন অধ্যক্ষ শ্রীমৎ তপনান্দ গিরি মহারাজ, পটিয়া পাঁচরিয়া তপোবন আশ্রমের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ রবীশ্বরানন্দ পুরী মহারাজ, ইসকন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলারাজ গৌর দাস ব্রহ্মচারী, বাঁশখালী ঋষিধামের মোহন্ত সচিদানন্দ পুরী মহারাজ, শ্রীমৎ মুরারী দাস বাবাজী ও তপোবন আশ্রমনের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ প্রাঞ্জলানন্দ পুরী মহারাজ।

সনাতন জাগরণ মঞ্চের আট দফা দাবিগুলো হলো—

১) সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দোষীদের দ্রুততম সময়ে উপযুক্ত শান্তি প্রদান, ক্ষতিগ্রস্তদের যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

২) অনতিবিলম্বে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে।

৩) সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে।

৪) হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে হিন্দু ফাউন্ডেশনে উন্নীত করতে হবে। পাশাপাশি বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টিকেও ফাউন্ডেশনে উন্নীত করতে হবে।

৫) দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।

৬) প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘুদের জন্য উপাসনালয় নির্মাণ এবং প্রতিটি হোস্টেলে প্রার্থনা রুম বরাদ্দ করতে হবে।

৭) সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড, আধুনিকায়ন করতে হবে।

৮) শারদীয় দুর্গাপজায় ৫ দিন ছুটি দিতে হবে।

আরবি/আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm