চট্টগ্রামে করোনা শনাক্তের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। নগর ছাড়িয়ে বেশ কয়েকটি উপজেলাও এখন করোনার ‘হটস্পট’ জোনে পরিণত হয়েছে। শনাক্তের হারও উদ্বেগজনক।
হাসপাতালগুলোতে এখন করোনা রোগীর ভিড়। মৃত্যুমিছিলে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন নাম।
সবমিলিয়ে দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের প্রায় দেড় বছর পর করোনার ‘পিক’ বা ‘সংক্রমণ চূড়া’ দেখছে চট্টগ্রাম।
চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত ৭২২ জন করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর জানিয়েছে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামের মোট ৬০ হাজার ৯২৭ নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়েছে।
এদিকে সংক্রমণের ঝুঁকির পরও সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি ও বিধিনিষেধ না মানার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট নামে পরিচিত এ ভারতীয় ধরন বর্তমানে দেশে করোনার বিস্তারে প্রভাব ফেলছে।
আলোচনায় ৩ সূচক
চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণের ‘পিক’ আলোচনায় আসার পেছনে মূলত তিনটি সূচক সামনে এসেছে। এগুলো হলো— চট্টগ্রামে গত কিছুদিনে করোনা সংক্রমণ (শনাক্ত রোগীর সংখ্যা), একইসময়ে করোনা শনাক্তের হার ও সংক্রমণের পরিধি।
সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা
চট্টগ্রামে করোনা রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। চলতি সপ্তাহেই দুবার ভেঙেছে জুন-জুলাইয়ের সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড।
শুধু নগর নয়, পুরো জেলাতেই এখন বাড়ছে করোনা শনাক্তের সংখ্যা।
সোমবার (৫ জুলাই) চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় জানায়, আগের ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামের ১ হাজার ৬৩৮ নমুনা পরীক্ষায় ৫৫৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এটি চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ে চট্টগ্রামে একদিনে সর্বোচ্চসংখ্যক করোনা শনাক্তের রেকর্ড। এরআগে গত ১ জুলাই চট্টগ্রামে ৫৫২ জনের করোনা শনাক্ত হয়।
শনাক্তের হার
চট্টগ্রামে করোনা শনাক্তের হারও উদ্বেগজনক। চলতি সপ্তাহেই জেলায় একাধিকবার ৩০ শতাংশের বেশি নমুনায় করোনা শনাক্ত হয়।
সর্বশেষ সোমবার আগের ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে করোনা শনাক্ত হয় ৩৪ শতাংশ নমুনায়।
গত এক সপ্তাহে একাধিক ল্যাবে ৭০ শতাংশের বেশি শনাক্তও দেখেছে চট্টগ্রাম।
সংক্রমণের পরিধি
চট্টগ্রামে নগর ছাড়িয়ে বিভিন্ন উপজেলাতেও এখন সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সংক্রমণের প্রথম ১২ মাসে গ্রামে তুলনামূলক কম শনাক্ত হলেও, এখন নগরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে উপজেলাগুলোতে।
গত এক সপ্তাহে চট্টগ্রামের পাঁচ উপজেলায় শনাক্তের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। উপজেলাগুলো হলো— ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজান, মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড।
এরমধ্যে মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড মিলে সাতদিনেই করোনা শনাক্ত তিনশ ছাড়ায়। সর্বশেষ সোমবার আগের ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামের উপজেলাগুলোর মধ্যে রাউজানে সর্বোচ্চ শনাক্তের খবর জানিয়েছে সিভিল সার্জন কার্যালয়।
এরআগে শনাক্তের ঊর্ধ্বগতির কারণে ফটিকছড়ি উপজেলা লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এছাড়া হাটহাজারীতে চট্টগ্রামের উপজেলাগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চসংখ্যক করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে।
অন্যদিকে নগরের বাকলিয়া থেকে কোতোয়ালি, পতেঙ্গা থেকে হালিশহর, অধিকাংশ এলাকাতেই করোনা রোগী মিলেছে। এরমধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু এলাকাকে রেড জোনও ঘোষণা করা হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞ যা বললেন
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ও কোভিড-১৯ (ইআরপিপি) প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক ডা. মো. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে গণসচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। মানুষকে সতর্ক করতে হবে। তবে আতঙ্ক ছড়ানো যাবে না। অপ্রয়োজনে বাইরে বের হওয়া উচিত নয়। শারীরিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। স্যানিটাইজার ব্যবহার বা সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। লকডাউন ও বিধিনিষেধ মেনে চলতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে প্রশাসনকে জোর খাটাতে হবে। কারণ দিনশেষে অবহেলার খেসারত তো সাধারণ মানুষকেই দিতে হবে।
তিনি বলেন, ভারতে করোনার সংক্রমণ বাড়ার পর থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে সতর্কতা বাড়ানো হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে সেভাবে সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না। আমরা মাস্ক নিয়ে, স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে এত প্রচারণা চালালাম, অথচ ঈদে বাড়ি ফেরার সময় অনেকেই তা পাত্তাই দিলো না।
মাস্ক পরার বিষয়ে গ্রামের মানুষের অনীহার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, গ্রামের অনেক মানুষ এখনও মনে করে এটা শহরের রোগ। এটা ঠিক, গ্রামের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। তবে এখন গ্রামেও অনেক করোনা রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তাই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মসজিদের ইমাম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মিডিয়ার মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় সচেতনতা বাড়াতে হবে।