সাতকানিয়ায় জসিমের মানববন্ধন ‘নাটক’—নেপথ্যে খুনের মামলা

হঠাৎ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় একটি মানববন্ধনকে ঘিরে চলছে নানা জল্পনা কল্পনা। মূলতই আওয়ামী লীগ সরকার আমলে হওয়া মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে এ মানববন্ধন। বিস্ময়কর হলেও সত্য, যিনি এ মানববন্ধন করেছেন তিনি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। এমনকি আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি! তবে টিম চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধান বলছে, আড়ালে রয়েছে অন্যকিছু। নিজেকে আওয়ামী লীগ বিরোধী সাজালেও, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে খুন ও অস্ত্র মামলা থেকে বাঁচতেই, এমন কৌশলের পথে গেলেন—ছাত্রলীগের সাবেক এ নেতা।

সাতকানিয়ার খাগরিয়া ইউনিয়নের, আওয়ামী লীগ মনোনীত সাবেক চেয়ারম্যান, মো. জসিম উদ্দিন। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সহিংসতার একাধিক মামলা। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের দুই থানায়ও রয়েছে খুন ও সহিংসতার মামলা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার ঘটনায় তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে একাধিক মামলায়। এসব মামলা থেকে বাঁচতেই তাঁর অনুগতদের দিয়ে মানবন্ধনের এমন নাটক সাজিয়েছেন জসিম।

অনুসন্ধান বলছে, বৃহস্পতিবার সাতকানিয়া উপজেলার খাগরিয়া ইউনিয়নের ভোর বাজারে, হঠাৎ দেখা মেলে লোকজনের। ব্যানার হাতে নিয়ে মানববন্ধন সাজিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে জসিমের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান লোকজন। তবে আলোকিত চট্টগ্রামের অনুসন্ধান বলছে, এই জসিম ছিলেন, খাগরিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ ছাত্রলীগেরও সাবেক সহসভাপতি ছিলেন তিনি।

স্থানীয়রা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার ঘটনায় চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানায় সহিংসতা মামলা ও চান্দগাঁও থানার খুনের মামলা থেকে বাঁচতেই মানববন্ধনের নাটক সাজিয়েছেন জসিম।

অনুসন্ধান বলছে, ২০১১ সালে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবু সাঈদ ও সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানের সমর্থনে খাগারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে জিতেন জসিম উদ্দিন। নির্বাচিত হয়ে,দ এলাকায় গড়েন ত্রাসের রাজত্ব। মাদক কারবারি থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এলাকাভিত্তিক দাঙ্গা-হাঙ্গামার জন্য লাঠিয়াল বাহিনীও রয়েছে তাঁর। মধ্যযুগীয় কায়দায় চালাতেন তার বাহিনী সশস্ত্র হামলাও।

আওয়ামী লীগ আমলে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি করা জসিমের একাধিক ছবি এসেছে আলোকিত চট্টগ্রামের অনুসন্ধানে। এতে তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ থেকে শুরু করে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের, বিশেষ সখ্যতার চিত্র ফুটে উঠেছে।

সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরী, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সাবেক সাংসদ
আবু রেজা মু. নেজামউদ্দিন নদভী, আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলামের সঙ্গে বেশকিছু ঘনিষ্ঠ ছবি রয়েছে জসিমের। যদিও জসিম মূলত দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবু সাঈদের অনুসারী ছিলেন। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর, নিজেকে ভিন্ন দল-মতের মানুষ হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করছেন জসিম।

২০২২ সালের ইউপি নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন জসিম। ৭ ফেব্রুয়ারির সেই নির্বাচনে আওয়ামী সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধিয়ে দেন—এমন অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ওই সময় নির্বাচনী কেন্দ্রে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মারামারিসহ বিস্ফোরক আইনে একাধিক মামলার আসামির তালিকায় উঠে জসিমের নাম। একে একে ১১টি মামলার আসামি হয়েও সাতকানিয়ার, পুরো খাগরিয়ায় বেপরোয়া ছিলেন জসিম।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় চান্দগাঁও থানায় হত্যা মামলা ও পাঁচলাইশ থানার আরেক মামলায়ও জসিমকে আসামি করা হয়। এসব মামলা থেকে বাঁচতে, জসিম মানববন্ধনের নাটক সাজিয়েছেন— দাবি এলাকার লোকজনের।

আওয়ামী লীগের সাবেক চেয়ারম্যান জসিম ভোল পাল্টিয়ে, এখন বিএনপি, জামায়াত কিংবা এলডিপির ঘাড়ে উঠারও পাঁয়তারা করছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

এলাকার লোকজন আলোকিত চট্টগ্রামকে জানান, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, ছাত্রদের ওপর হামলায় হত্যা মামলা থেকে বাঁচতে পল্টি মারতে চাইছেন জসিস। মূলত গ্রেপ্তার এড়াতে লোকজন জড়ো করে সাজানো মানববন্ধনে করে জসিম। গণমাধ্যমে এমন মানববন্ধনের সংবাদ প্রকাশ করে আদালতের দৃষ্টি কুড়িয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে কৌশলের ছক আঁকেন জসিম উদ্দিন।

১৯৮৮ সালে ছাত্রলীগ করতেন স্বীকার করে জসিম উদ্দিন আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ছাত্র অবস্থায় ছাত্রলীগ করতাম। পরে দীর্ঘদিন বিদেশ ছিলাম। বিদেশ থেকে এসে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছি।

জসিমের দাবি, চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর সবার সঙ্গে মেশার কারণে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান এলাকায় জামায়াত-শিবির প্রতিষ্ঠা করছি বলে অভিযোগ তুলেন তাঁর বিরুদ্ধে। এর পর থেকে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করা শুরু করেন মফিজুর রহমান।

স্থানীয় এমপির সঙ্গে সখ্যতার বিষয়ে জসিম বলেন, এলাকার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আমি যেতাম। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁকে সহযোগিতা করতাম।

জসিম বলেন, সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু গতবার বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করায় আমাকে জামায়াত-শিবির বানিয়ে দিয়েছে। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে আমাকে সাবেক ছাত্রলীগ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে।

জসিমের দাবি, আওয়ামী সরকার আমলে তাঁর বিরুদ্ধে সাতটি মিথ্যা মামলা হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলেও দুটি মিথ্যা মামলা হয়েছে। সবাই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন বলে দাবি জসিমের।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm