চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ তিনি। হাসির জন্য চট্টগ্রামজুড়ে দারুণ খ্যাতি রয়েছে তাঁর। আসল নাম ‘দিলীপ হোড়’ হলেও এই নামে তাঁকে খুব কম লোকই চেনেন। তবে ‘মেরা মিয়া’ কিংবা ‘মিডা চুনচুন্যা’ বললে তাঁকে চেনেন না চট্টগ্রামে এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন।
মানুষকে বিনোদন দেওয়াই ছিল মেরা মিয়ার কাজ। অসংখ্য মানুষকে হাসানো সেই মিডা চুনচুন্যার মুখের হাসিই আজ হারিয়ে গেছে! অসুস্থ দিলীপ হোড় আজ ঘরবন্দী হয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছেন বিছানার এক কোণে।
কখনো চার্লি চ্যাপলিনের মতো দাঁড়ি-গোফের সঙ্গে হাফ পেন্ট পড়ে, আবার কখনো গলায় কলসি ঝুলিয়ে তিনি বিনোদন দিয়েছেন দর্শকদের। অভিনয়ের সুবাদে যুক্ত ছিলেন অনেক শিল্পী সংগঠনের সঙ্গে। কিন্তু তাঁর এই কঠিন পাশে নেই কোনো সংগঠন। অনেকে জানেনই না তিনি অসুস্থ।
দিলীপ হোড় ওরফে মিডা চুনচুইন্যা ওরফে মেরা মিয়ার অভিনয়ের শুরুটা ১৯৭৬ সাল থেকে। ১৯৫৫ সালে বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের এলাকা চট্টগ্রামের পটিয়া ধলঘাট এলাকার আলামপুর গ্রামে তার জন্ম। এক ছেলে অন্তর হোড় ও এক মেয়ে আরশি হোড় ছাড়া তিনি অন্য কোনো সম্পদ জুড়াতে পারেননি অভিনয় জগত থেকে।
হানিফ সংকেতের টক শো ‘কথায় কথায়’ থেকে শুরু করে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, শর্টফিল্ম, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নাটক, গান ও বিজ্ঞাপনে অভিনয় করেছেন তিনি। লাখো মানুষের হাসির খোরাক এ মিডা চুনচুন্যা গত ৬ মাস ধরে ঘরবন্দী পড়ে আছেন। শরীরে বাসা বেঁধেছে বার্ধক্যজনিত রোগ। ভিটামিন ও প্রোটিনের অভাবে শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে ঘরের এক কোণে। যাঁর কথায় বাংলার মানুষ বাঁধভাঙা উল্লাস করতো, সেই মুখে আজ বুলি নেই।
জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে বেশকিছু বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি অন্যতম কৌতুক অভিনেতা হিসিবে কাজ করেন। এসব চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের খ্যাতিমান অভিনেতা আনোয়ার হোসেন, ইলিয়াস কাঞ্চন, অমিত হাসান, রাজীব, মিশা সওদাগরের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া আশিক প্রিয়া, দরদী সন্তান, রাজা গুণ্ডা, চরম আঘাত, নয়নের কাজল, মহা শক্তি নামে সিনেমায় মিডা চুনচুইন্যাকে দেখা গেছে।
দিলীপ হোড়ের সাড়া জাগানো অভিনয় মুগ্ধ করেছে দর্শক ও পরিচালকদের— বলছিলেন নাট্য পরিচালক ও চট্টগ্রাম শিল্পী সংস্থার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাছির চৌধুরী। তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, পরিবার-পরিজন ফেলে রাজধানীতে পাড়ি জমালে তার করা সিনেমার সংখ্যা সেঞ্চুরি পার হয়ে যেত। কিন্তু তিনি চট্টগ্রামকে ভালোবেসে ছেড়ে যাননি। বার্ধক্যজনিত অসুখ তাকে গ্রাস করেছে। তিনি সহযোগিতা না চাইলেও বর্তমানে তাঁর সহযোগিতা প্রয়োজন। এ বিষয়ে আমরা বৈঠক করে এ গুণী শিল্পীর জন্য কিছু ফান্ডের ব্যবস্থা করবো।
খাগড়াছড়ির মেয়ে মিডা চুনচুইন্যার স্ত্রী মীনা হোড় বলেন, ১৯৯৪ সালের ২৪ অক্টোবর আমাদের বিয়ে হয়। সৌহার্দ্যপূর্ণ সংসারে তিনি আমাকে একটি বড় কথাও কোনোদিন বলেননি। বর্তমানে চিকিৎসার আর্থিক সক্ষমতা না থাকলেও তিনি কারো মুখাপেক্ষী হতে চান না। তবে ফিনলে চা, বিনিময় টাওয়ার, ডাটাবাজার, ফুলমেলা, ফাইভস্টার লুঙ্গিসহ যেসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে তিনি কাজ করেছে তারা হাত বাড়ালেও অনেক সহযোগিতা হতো।
বাংলা ‘রেড ড্রাগন টু রজনী গন্ধ্যা’ ও ‘তক্ষক’ নাটকে দিলীপ হোড়কে দেখা যায়। গাঁ গেরামের মোড়ল, সাম্পানওয়ালা, সোনাই বন্ধু, রঙিলা ভাবী, মিলন মেলা, বধু এলো ঘরে, স্বামী আছে সিঁদুর নেই, ভিখারিনী মা, রামপ্রসাদসহ বিভিন্ন মঞ্চ নাটকেও তিনি অভিনয় করেন।
১৯৮৪ সালে করা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নাটক মিডা চুনচুন্যার কেরামতি থেকে তাঁর নামের উদ্ভব হয়েছে। এরপর একে একে বাতাসী কালোনগর (১৯৮৭), বয়সের দোস (১৯৯৪), বাচা মিয়ার হাছা কথা (১৯৯০), বউ পাগলা সোনা মিয়া, দিলে যারে চাই, রঙ্গিলা ভাবী, চাটগাঁইয়া বউ, বকুল মাঝী, পরানের ভাবী, মন দিলাম যারে, চাইলে বুঝিবা, জয় বাবা লোকনাথ, তিন বাটপারসহ অসংখ্য নাটকে তিনি অভিনয় করেন।
নাট্য পরিচালক মহসিন চৌধুরী বলেন, দুযুগেরও বেশি সময় ধরে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। তার সুস্থতা কামনা করছি। একইসঙ্গে সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে তার পাশে থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষের পরানর ধন, বাইক্কা টেয়া দে অ্যালবামের মিউজিক ভিডিওতে অভিনয় করেছেন মেরা মিয়া ওরফে মিডা চুনচুইন্যা। এছাড়া বাস কন্ডাকটার, পিরিত মানে পুডুর পাডুর, জেডা ফইরার বাপ, আঁরে পাম নদ্যু, দেশে গেলে কইয়েন গো ভাইসা, মানা গইজ্জিলাম তোরে পিরিত ন গরিস, ওরে নুরানি বালাসহ অনেক মিউজিক ভিডিও অ্যালবামে তিনি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন।
এদিকে দিলীপ হোড়ের খোঁজ-খবর নিয়ে তাঁকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন চট্টগ্রাম মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন।
বঙ্গবন্ধু সংস্কৃতি জোট সভাপতি আমিনুল হক বাবু বলেন, দিলীপ হোড় একজন সাংস্কৃতিক সংগঠক ছিলেন। অনেকে হয়ত তাঁর অসুস্থতার বিষয়টি জানেন না। আশা করি সাংস্কৃতিক কর্মী ও নেতারা তাঁর পাশে থাকবেন।
আলোকিত চট্টগ্রাম
মন্তব্য নেওয়া বন্ধ।