মেয়রও ‘ব্যর্থ’, চকবাজার কাঁচাবাজার—যে লাউ সেই কদু
ঢাক-ঢোল পিটিয়ে চালু করা চকবাজার কাঁচাবাজারের দ্বিতীয় তলায় সবজির বাজার তিন মাস পার হতেই প্রায় খালি হয়ে গেছে। ৬৮ জন ভাসমান ব্যবসায়ীর মধ্যে আছেন মাত্র ৭ জন। বাকিরা আগের মতো রাস্তা-ফুটপাত দখল করে চালাচ্ছেন বাণিজ্য। ফলে যানজটসহ চলাচলে বেড়েছে ভোগান্তি। এলাকায় পুরনো চেহারা ফিরে আসায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় ও পথচারীরা।
শনিবার (২৬ এপ্রিল) বেলা ১২টায় সরেজমিন চকবাজার কাঁচাবাজারের দ্বিতীয় তলা ঘুরে করে দেখা যায় এমন চিত্র।
এর আগে ১ জানুয়ারি সকালে চকবাজার কাঁচাবাজারের দ্বিতীয় তলায় সবজি বাজারের উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। এসময় তিনি বলেন, চকবাজার কাঁচাবাজারটি ঐতিহ্যবাহী একটি বাজার। অতীতে রাস্তা-ফুটপাতে বাজার বসার কারণে এখানে সাধারণ মানুষ হাঁটতে পারত না। প্রতিনিয়ত যানজটের সৃষ্টি হতো। বাজার ঘিরে চাঁদাবাজি হতো। বর্তমানে অনেক বছর পরে এলাকাবাসীর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার একটা সুযোগ হয়েছে। আজকে মনে হচ্ছে পরিষ্কার পরিষ্কার একটা ভাব। আজকে সবার কাছে একটা অচেনা শহর মনে হচ্ছে। আর এই পরিবেশ আমরা অক্ষুণ্ন রাখব। কোনো চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী যারা আগে আওয়ামী লীগের দোসর ছিল তাদের এখানে স্থান হবে না।
অথচ বর্তমানে ফিরে এসেছে সেই আগের চিত্র। সরেজমিন দেখা যায়, দ্বিতীয় তলায় উঠতেই হাতের ডান পাশের দুদিকে মোট ৭ জন সবজি ব্যবসায়ী রয়েছেন। অপর দিক পুরোপুরি খালি। সেখানে কেউ পেঁয়াজ পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত, কেউ ঘুমাচ্ছেন। দলবেঁধে আড্ডা দিতেও দেখা গেল। ক্রেতাদের আনাগোনাও তেমন নেই। হাতেগোনা কয়েকজন সবজি কিনছেন। আর তৃতীয় তলা এখনও খালিই পড়ে আছে।
আরও পড়ুন : আলোকিত চট্টগ্রামে প্রতিবেদনের ৫ দিন—চকবাজার কাঁচাবাজারের দুই ফ্লোরের একটি চালু
কাঁচাবাজারের বিপরীতে মন্দির সংলগ্ন ফুটপাত দখল করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন মালামাল। একই স্থানে একটি ট্রাকে মেয়রের ব্যানার লাগিয়ে রাস্তা-ফুটপাতে দখল করে চলছে ন্যায্যমূল্যের পণ্য বিক্রি। এছাড়া ধুনীরপুল থেকে ফুলতলা ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তার এক পাশ দখল করে বসেছে বাজার। যেখানে চলছে সবজি ও মাছ বিক্রি।

রাস্তা দখল করে মাছ বিক্রি চলছে বাকলিয়া খাল পাড় এলাকায়ও। পাশাপাশি ওই এলাকায় চলছে চাক্তাই খালে রিটার্নিং ওয়াল ও ফুলতলা ব্রিজ নির্মাণের কাজ। দখলের কারণে রাস্তা সংকুচিত হওয়ায় যান চলাচলে সমস্যার পাশাপাশি পথচারীদেরও দুর্ভোগের অন্ত নেই। তবে সার্বক্ষণিক নজরদারির কাজে নিয়োজিত দুজনকে তখন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বাজারের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত একজন জানান, রাস্তা-ফুটপাতে মালামাল না রাখতে বললে কেউ শুনে না। বাজারের দ্বিতীয় তলা খালি পড়ে আছে। যে যার ইচ্ছেমত যেখানে খুশি সেখানে রেখে চলে যায়।
দ্বিতীয় তলার ব্যবসায়ীরা জানান, বাজার চালুর পর থেকে দ্বিতীয় তলায় ক্রেতারা বাজার করতে কম উঠে। সেজন্য বেচাবিক্রি কম। রাস্তায় ভ্যানে পণ্য বিক্রিও কমেনি। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে নিচে রাস্তায় নেমে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা সুজিত কুমার দাশ বলেন, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি কাঁচাবাজারের দ্বিতীয় তলা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখছি হাতেগোনা কয়েকজন। সবাই আগের মতো যে যার জায়গায় রাস্তা-ফুটপাত দখল করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব দেখার এখন কেউ নেই। তাহলে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এমন উদ্যোগের কী প্রয়োজন ছিল?
অনুসন্ধানে জানা যায়, চকবাজার কাঁচাবাজারের ইজারাদার পরিবর্তন হয়েছে। এখন হাসিল আদায় করা হচ্ছে ১৫০ টাকা। আবার যারা রাস্তা-ফুটপাতে ব্যবসা করছে তাদের কাছ থেকে হাসিলসহ জায়গা ভাড়ার নামে নেওয়া হচ্ছে ১০০ টাকা করে। জায়গা ভাড়া না দিলে রাস্তা-ফুটপাতে বসার কোনো সুযোগ নেই।
অভিযোগ আছে, রাস্তা-ফুটপাত দখল করে কেউ যাতে ব্যবসা চালাতে না পারে সেজন্য দুজনকে সার্বক্ষণিক নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হলেও তারা এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। ফলে চকবাজার পুনরায় দখলবাণিজ্য জমজমাট হয়ে উঠেছে।
এদিকে রাস্তার ভাসমান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের কথা। তবে উচ্ছেদের ভয়ে কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ভাসমান ব্যবসায়ী জানান, বাজারের দ্বিতীয় তলায় বেচা-বিক্রি একেবারে কম। উপর থেকে নিচে বিক্রি ভালো হয়। তবে এখানে প্রতিদিন হাসিল ১৫০ টাকা ও জায়গা ভাড়া ১০০ টাকাসহ মোট ২৫০ টাকা দিতে হচ্ছে। না দিলে আবার উপরে তুলে দেয়, এখানে বসতে দেয় না। বাধ্য হয়ে দিতে হচ্ছে। তবে এমন নিয়ম আগেও ছিল বলে জানান তারা।

জানা যায়, চকবাজার এলাকার বিভিন্ন জায়গায় অপরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনকল্পে পরিচ্ছন্ন, পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল বাজার গঠনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্মিত কাঁচাবাজার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এছাড়া পুনরায় রাস্তা-ফুটপাত দখল করে কেউ যাতে ব্যবসা চালাতে না পারে সেজন্য দুজনকে সার্বক্ষণিক নজরদারির জন্য নিয়োগ করা হয়।
এর আগে গত ২৬ ডিসেম্বর আলোকিত চট্টগ্রামে ‘চকবাজার কাঁচাবাজারের দুই ফ্লোর চালু না হওয়ার নেপথ্যে, নতুন মেয়রের বিশেষ ছাড়ের ঘোষণায়ও সাড়া নেই’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।
সংবাদ প্রকাশের ৫ দিন পর চালু করা হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালিত চকবাজার কাঁচাবাজারের দ্বিতীয় তলা। সেখানে বসে সবজির বাজার। রাস্তা-ফুটপাত দখল করে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করা ভাসমান ৬৮ জন ব্যবসায়ীকে বসানো হয় দ্বিতীয় তলায়। ফলে কাঁচাবাজারসহ আশপাশের এলাকার রাস্তা-ফুটপাত দখলমুক্ত হওয়ায় পথচারীরা নির্বিঘ্নে হাঁটাচলার সুযোগ পান। কিন্তু বর্তমানে দখলের কারণে নির্বিঘ্নে হাঁটাচলার সুযোগ আর নেই।
পথচারী মো. জুবায়ের বলেন, ভেবেছিলাম নতুন মেয়রের উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখবে। কিন্তু এখন দেখছি যে লাউ সেই কদু। রাস্তা-ফুটপাত দখল করে আবারও শুরু হয়েছে বাণিজ্য। পুরনো দুর্ভোগ আবার ফিরে এসেছে।
জানা যায়, ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় চকবাজার কাঁচাবাজার ভবন। এটি পরিচালনা করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর উদ্বোধনের পর নিচতলা চালু হলেও নানা চেষ্টার পরও পাঁচ বছরেও চালু করা যায়নি দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা।
আরও পড়ুন : চকবাজার কাঁচাবাজারের দুই ফ্লোর চালু না হওয়ার নেপথ্যে
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নতুন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন নতুনভাবে বাজারটি চালুর উদ্যোগ নেন। খালি পড়ে থাকা দুটি ভবন চালু করতে রাস্তা-ফুটপাত দখল করে থাকা ভাসমান ব্যবসায়ীদের বসার অনুরোধ জানান মেয়র। এছাড়া আগামী ৫ মাস ভাড়া না নেওয়ারও ঘোষণা দেন। আশ্বাস দেন, পর্যায়ক্রমে সবাইকে পুনর্বাসনেরও। কিন্তু বাজার চালুর তিন মাস পার হতেই ভেস্তে গেল সেই প্রসংশনীয় উদ্যোগ।
এর আগে গত ২১ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাস্তা-ফুটপাত দখলমুক্ত করতে চকবাজার এলাকায় অভিযান চালায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। এতে নেতৃত্ব দেন মেয়রের একান্ত সহকারী মারুফুল হক চৌধুরী। এসময় ভাসমান ব্যবসায়ীদের চকবাজার কাঁচাবাজার ব্যবহারে মেয়রের আহ্বান সবার সামনে তুলে ধরে বক্তব্য দেন তিনি। এছাড়া গত ৮ ডিসেম্বর রাতে চকবাজার এলাকায় অভিযান চালানো হয়েছিল। কিন্তু অভিযান শেষে ফিরে আসে দখলের সেই পুরনো চিত্র।

এসব বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
এরপর মেয়রের একান্ত সহকারী মারুফুল হক চৌধুরী হক চৌধুরী মুঠোফোনে কল করা হলে সাড়া দেননি তিনিও।
প্রসঙ্গত, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম দায়িত্ব থাকার সময় সাড়ে ১০ গণ্ডা জায়গার ওপর ৯ তলা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। পাইলিংয়ের কাজ শেষে এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকে কাজ। পরে ২০১৬ সালে আবার শুরু হয় দ্বিতীয় তলার কাজ। কাঁচাবাজারের তিন তলা উঠতেই সময় লাগে ৭ বছর।
আলোকিত চট্টগ্রাম