‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি…’। শুরু হলো বাঙালির ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি।
আজ ১ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের এদিনে রাষ্ট্র রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকার রাজপথে জীবন উৎসর্গ করেন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত, রফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকে। তাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালির জাতীয় জীবনে।
এদিকে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। এর মধ্যদিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে। ফেব্রুয়ারিজুড়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বাঙালিরা স্মরণ করে ভাষা শহীদদের।
আরও পড়ুন : ২১ ফেব্রুয়ারি, শোকের দিন—শক্তিরও
এদিকে ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই শুরু হচ্ছে বিভিন্ন কর্মসূচি। চট্টগ্রাম নগরে শুরু হচ্ছে বইমেলা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) উদ্যোগে এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়াম মাঠে আজ ১ ফেব্রুয়ারি থেকে অমর একুশে বইমেলা শুরু হচ্ছে। ২৬ দিনব্যাপী এ বই মেলা শেষ হবে ২৬ ফেব্রুয়ারি। প্রতিদিন দুপুর ৩টা থেকে রাত ৯টা এবং ছুটির দিনে সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে বইমেলা।
আজ দুপুর ৩টায় মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন গৃহায়ন, গণপূর্ত ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, গণপরিষদের সভাপতি এবং মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক সভায় বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়।’
কার্জন হলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলার পর কয়েকজন ছাত্র ‘না’ ‘না’ বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ করেছিলেন, যা জিন্নাহকে অপ্রস্তুত করেছিল। এ ঘটনার পর জিন্নাহকে একটি স্মারকলিপিও দিয়েছিল একদল ছাত্র। এতে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। শুরু হয় রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলন।
এর আগে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র ও অধ্যাপক মিলে তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সংগঠন সৃষ্টি করেন। যারা শুরু থেকেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে নানারকম সভা-সমিতি আলোচনার আয়োজন করে। গঠিত হয়েছিল ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও’। ভাষা আন্দোলন জোরদার করে তোলে এ সংগঠন।
১৯৪৮ সালে তমদ্দুন মজলিস, গণআজাদী লীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও বিভিন্ন ছাত্রাবাসের যৌথ উদ্যোগে ২ মার্চ ফজলুল হক হলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ওইদিন এক প্রস্তাবে সারা পূর্ব বাংলায় ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট ডাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। শেখ মুজিব, শামসুল হক, অলি আহাদসহ ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হলে ঢাকায় ১৩ থেকে ১৫ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়।
১৯৪৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে বাংলা ভাষা আরবি হরফে লেখার প্রস্তাব উত্থাপন করেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান। এরপর ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে তিনি বাংলা হরফকে বাদ দিয়ে তার স্থলে আরবি হরফে বাংলা লেখা প্রবর্তনের ঘোষণা দেন।
এ ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা মোস্তফা নূর উল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভা করে। নজরুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, ইলা দাশগুপ্ত, নূরুল ইসলাম, মমতাজ বেগম, রিজিয়া সিদ্দিকী, খলিলুর রহমান প্রমুখের সমন্বয়ে একটি বর্ণমালা সাব-কমিটি গঠন করা হয়। শুরু হয় বাংলা হরফ বিতাড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
বাংলাভাষার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে শহীদ হন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত, রফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকে।
এরপর পথ পরিক্রমায় রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। সেই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরে ৯ মাসব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্যদিয়ে ১৯৭১ সালে বীর বাঙালি পায় স্বাধীন বাংলাদেশ।
আরবি/আলোকিত চট্টগ্রাম