চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বাড়ছে। চলতি বছরের শুরু থেকেই বাড়তে থাকা ডেঙ্গুর বিস্তার বছরের মাঝামাঝি এসে ভয়াবহ রুপ নেয়। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু কেড়ে নিয়েছে ১২ প্রাণ।
এদিকে আগে থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার বিষয়ে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সতর্কবার্তা ছিল। তারপরও মশা নিধনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মশা নিধনে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে নগরে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা চরম মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ৩ জন। এরপর ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত কেউ এ রোগে মারা না গেলেও আক্রান্ত হয়েছেন প্রতিমাসেই। তবে জুনো আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায় ডেঙ্গু আক্রান্ত মৃতের সংখ্যা।
জুনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামে মারা যায় ৬ জন। চলতি মাসের শুরুতেই তা আরো ভয়াবহ রূপ নেয়। জুলাই মাসের প্রথম ৬ দিনেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ৩ জনের। এ নিয়ে চলতি বছরে এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগে এডিস মশা বাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর এলাকার ৭ জন।
এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৫ জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রামে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে ৬৬১ জন। এর মধ্যে মহানগর এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪৬১ জন এবং উপজেলায় ২০০ জন।
আরও পড়ুন : ডেঙ্গুর হানা চট্টগ্রামেও, মাথাব্যথা নেই সিটি করপোরেশনের—১২ এলাকায় বাড়ছে রোগী
এদিকে সর্বশেষ গত ৪ জুলাই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যায় নগরের সেন্ট স্কলাস্টিকা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী শ্রাবণী সরকার। এছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে শ্রাবণীর মা বিটু সরকার ও বড় ভাই সৌভিক সরকার বর্তমানে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তারা চট্টগ্রাম মহানগরের সদরঘাট পোস্ট অফিস গলির বাসিন্দা।
সিভিল সার্জন সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে আরও ২৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া বর্তমানে চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ১৪২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ রুখতে নাগরিক সচেতনতার পাশাপাশি বিভিন্ন বাসা বাড়িসহ নানা জায়গায় এডিস মশার উৎপত্তিস্থল পর্যবেক্ষণে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নিয়মিত অভিযান পরিচালনা এবং মশা নিধনে কার্যকরী পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মশা নিধনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এবারের বাজেট ৫ কোটি টাকা। যা এ যাবতকালের মধ্যে মশা নিধনে চসিকের সর্বোচ্চ বাজেট।
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মু. আবুল হাশেম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা ২৩ জুন থেকে ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করেছি। ক্রাশ প্রোগ্রামের জন্য কিছু কিছু ওয়ার্ডে ৪ জন ও কিছু ওয়ার্ডে ৬ জন করে স্প্রেম্যান রয়েছে। এছাড়া আমরা আরো ৬০ জন এখানে যুক্ত করে ১০ দলে ক্রাশ প্রোগ্রামের জন্য তাদের ভাগ করে প্রথমে আবাসিক এলাকাগুলো কাভার করেছি। এখন বিভিন্ন অলি-গলিতে ক্রাশ প্রোগ্রাম চালাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমরা অভিযান শুরু করেছি। পাঁচলাইশ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৯৩৭ সাবানের মালিকসহ ২ জনকে জরিমানা করেছি। এছাড়া আমরা মাইকিং শুরু করেছি, লিফলেট বিতরণ চলছে। আমরা ড্রোন ব্যবহার করে নগরের বিভিন্ন বাসা-বাড়ির ছাদসহ যেখানে আমরা সহজে পৌঁছাতে পারি না সেসব জায়গায় মশার উৎপত্তিস্থল রয়েছে কি-না পর্যবেক্ষণ করবো।
মশা নিধনে ব্যবহৃত ওষুধের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে আবুল হাশেম বলেন, এবারের ওষুধটা অনেক কার্যকরী। এটা আমরা বাংলাদেশ বিমান বাহিনী কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে নিয়েছি। এটার কার্যকারিতা পরীক্ষা করে আমরা দেখেছি এটা প্রায় ৯৯% কার্যকর।
গত মে থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করলেও মশা নিধনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করা হয়েছে ২৩ জুন থেকে। ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে কিনা জানতে চাইলে প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা বলেন, স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিবছর জুলাই থেকেই মূলত ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। তাই পরিকল্পনা মতো আমরা গত ২৩ জুন থেকে ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করেছি। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে এবার মে থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে। মশা নিধনে এবার আমরা সর্বোচ্চ অর্থ ব্যবহার করছি। ইতোমধ্যে ৫০টি ফগার মেশিন কিনেছি। আগে মশক নিয়ন্ত্রণ শাখা ছিল না, আমরা এবার মশক নিয়ন্ত্রণ শাখা করেছি, কর্মকর্তা নিয়োগ দিছি।
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. মো. ইলিয়াছ চৌধুরী আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, সাধারণত জুন থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এর প্রকোপ চলে। সেপ্টেম্বরের দিকে তা কমতে শুরু করে। আমরা চট্টগ্রামে মশা নিধনে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে গত এপ্রিল থেকেই সতর্ক করেছিলাম কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য। গত মাস থেকে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লেও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়নি এমন কোনো মাস ছিল না। প্রতি মাসেই কেউ না কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, এ বছর যে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে অনেক আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল। সেই সতর্কবার্তার বাস্তব রূপই হচ্ছে বর্তমানে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কার্যকরী পদক্ষেপের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। আপনাদের মাধ্যমে আমি সেই বার্তাই মানুষকে দিতে চাই। পরিবারে কেউ জ্বরে আক্রান্ত হলে হাতুড়ে ডাক্তার বা ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে না খেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। রোগীকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না।
এসআই/আলোকিত চট্টগ্রাম