ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে গড়েছেন তৈরি পোশাক কারখানা। নানা কৌশলে প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৩শ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। ঋণ শোধ না করায় ব্যাংকের করা মামলায় বিবাদীদের স্বশরীরে উপস্থিত হওয়ার আদেশ দেন আদালত। তবে সেই নির্দেশ অমান্য করায় এএন্ডবি আউটারওয়্যার লিমিটেডের মালিকদের বিরুদ্ধে একতরফা রায় ঘোষণা করেছেন আদালত।
বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদলতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান এ রায় দেন।
এ বিষয়ে আদালতের বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, মামলার বিবাদীদের বারবার হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পরও তারা আদালতে হাজির হননি। বৃহস্পতিবার বিবাদীপক্ষের আইনজীবী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আদালতে উপস্থিত থাকতে না পারায় সময়ের আবেদন করেন। কিন্তু বিচারক তা নামঞ্জুর করেন।
আদালতের রায়ে বলা হয়, আমমোক্তারের মাধ্যমে বিবাদীরা কনটেস্ট করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা বিদেশে অবস্থান করে আদালতের আদেশ অমান্য করায় তাদেরকে আমমোক্তার মাধ্যমে কনটেস্ট করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। স্বশরীরে হাজির না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে একতরফা রায় ঘোষণা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন : টাকা মেরে পালিয়ে ছিল ছদ্মবেশে, অবশেষে বউ-জামাই ধরা খেল চট্টগ্রামে
মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ৫ আগস্ট মার্কেন্টাইল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ১২২ কোটি ৬৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৫৩ টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ে এএন্ডবি আউটারওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল আবেদীন, চেয়ারম্যান মাইকেল কোল্ড, নাজমুল আবেদীনের স্ত্রী সোহেলা আবেদীনকে বিবাদী করে আদালতে মামলা করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। মামলায় ব্র্যাক ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখাকে মোকাবেলা বিবাদী বা প্রফরমা ডিফেন্ডেন্ড করা হয়। সম্পত্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকায় এ মামলার নিষ্পত্তির জন্য ব্র্যাক ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখাকে পক্ষ করা হয়।
জানা গেছে, নাজমুল আবেদীন ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম ইপিজেডে ‘এএন্ডবি আউটওয়্যার’ নামে একটি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেন। পরের বছরের শেষদিকে স্ত্রী সোহেলা আবেদীন ও শ্বশুর একেএম জাহিদ হোসেনের নামে কিনেন ‘নর্ম আউটফিট অ্যান্ড এক্সেসরিজ’ নামের অন্য একটি প্রতিষ্ঠান। পরে ‘কোল্ড প্লে স্কুল প্রোডাক্ট’ নামে আরও একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
এরপর ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর নাজমুল আবেদীন তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এএন্ডবি আউটারওয়্যার থেকে দুবাইয়ের এআরজিটিএল প্রতিষ্ঠানে পণ্য রপ্তানির নামে ৭টি বিক্রয় আদেশের বিপরীতে ১০ দশমিক ৮৫ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যমানের ৭টি রপ্তানি আদেশ ইস্যু করার আবেদন করেন মার্কেন্টাইল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায়। কমার্শিয়াল ব্যাংক অব দুবাইয়ের মাধ্যমে এ লেনদেন সম্পন্ন করারও নিশ্চয়তা দেন। রপ্তানির ৫ মাস পর ২০১৯ সালের ১২ মার্চ একটি রপ্তানি বিলের মূল্য বাবদ ২ দশমিক ৫ লাখ ডলার প্রত্যাবাসন করেন নাজমুল। বাকি ৬টি বিলের মূল্য বাবদ ৮ দশমিক ৮০ লাখ মার্কিন ডলার আর দেননি।
একইভাবে ব্র্যাক ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার মাধ্যমে ২০১৮ সালে দুটি বিক্রয় আদেশের বিপরীতে দুবাইয়ের একই প্রতিষ্ঠানের কাছে ৫ দশমিক ৩৯ লাখ ডলার মূল্যমানের পণ্য বিক্রি করে এএন্ডবি আউটারওয়্যার। পরবর্তী সময়ে দেড় লাখ মার্কিন ডলার প্রত্যাবাসন হলেও বাকি ৩ দশমিক ৪৮ লাখ মার্কিন ডলার পাওয়া যায়নি।
এছাড়া নগরের আগ্রাবাদের ওয়ান ব্যাংক থেকে নর্ম আউটফিট অ্যান্ড এক্সেসরিজ থেকে ২৯ দশমিক ৯ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যমানের পণ্য দুবাইয়ে পাঠাতে ১৯টি রপ্তানি ইস্যু করতে অনুরোধ করা হয়। ওই রপ্তানিমূল্যের মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ১৯ লাখ ডলার দেশে ফেরত আসে। বাকি ২৭ দশমিক ২৭ লাখ মার্কিন ডলার এখনও ফেরত আসেনি।
আরও পড়ুন : আরএসআরএম’র ফাঁদে ১০ ব্যাংকের ২২০০ কোটি টাকা, খেলছে পিতা-পুত্র
এনআরবিসি ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার মাধ্যমে ৯ দশমিক ৮৮ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের ৬টি রপ্তানি ইস্যু করা হয়। ওই অর্থের মধ্যে ১ দশমিক ৭৯ লাখ ডলার দেশে এলেও বাকি ৮ দশমিক ৯ লাখ ডলার আসেনি।
এদিকে নাজমুল আবেদীন তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুপ্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেন। এর মধ্যে এএন্ডবি আউট ওয়্যারের কাছে ব্র্যাক ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার পাওনা ১০২ কোটি টাকা। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট পাবে ৬০ কোটি টাকা। এছাড়া নর্ম আউটফিটের কাছে ওয়ান ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা ৫৪ কোটি টাকা এবং এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা পাবে ২৯ কোটি টাকা। ওই তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে স্থানীয় সরবরাহকারীরা অন্তত ৫০ কোটি টাকা পাবেন বলে জানা গেছে।
জানা যায়, নিজ প্রতিষ্ঠানের তৈরি পোশাক দুবাইয়ে রপ্তানি করার ঘোষণা দিয়ে ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিতেন নাজমুল। দুবাইয়ে যে প্রতিষ্ঠানকে ক্রেতা হিসেবে দেখানো হয়েছিল সেটির মালিকও ছিলেন নাজমুল নিজেই। এভাবে রপ্তানিকারক ও আমদানিকারক সেজে নাজমুল, স্ত্রী ও শ্বশুর বিদেশে প্রচুর অর্থ পাচার করেছেন।
আরএস/আরবি