বাড়ছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস—করণীয় বললেন বিশেষজ্ঞ

দেশে করোনাভাইরাসের ‘ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট’ ও ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ শনাক্তের খবরে জনমনে উদ্বেগ বেড়েছে। এ অবস্থায় নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। স্থানীয়ভাবে বেশ কয়েকটি জেলায় ঘোষণা করা হয়েছে লকডাউন।

এদিকে সংক্রমণের ঝুঁকির পরও সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি ও বিধিনিষেধ না মানার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট নামে পরিচিত এ ভারতীয় ধরন বর্তমানে দেশে করোনার বিস্তারে প্রভাব ফেলছে।

অপরদিকে করোনার মধ্যেই নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ। ভারতের পর বাংলাদেশেও সম্প্রতি ব্ল্যাক ফাঙ্গাস শনাক্ত হয়েছে। দেশে ইতোমধ্যে একাধিক রোগীর মধ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের কথা জানিয়েছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ।

করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। এ মুহূর্তে সবার প্রশ্ন একটাই— বর্তমান পরিস্থিতিতে সতর্ক থাকতে করণীয় কী?

এ ব্যাপারে জানতে কথা হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ও কোভিড-১৯ (ইআরপিপি) প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক ডা. মো. আজিজুর রহমান সিদ্দিকীর সঙ্গে। আলোকিত চট্টগ্রামের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতায় উঠে এসেছে করোনা, স্বাস্থ্যবিধি, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টসহ নানা প্রসঙ্গ।

ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ রোধে সম্মিলিত উদ্যোগ ও গণসচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই মন্তব্য করে ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, মানুষকে সতর্ক করতে হবে। তবে আতঙ্ক ছড়ানো যাবে না। অপ্রয়োজনে বাইরে বের হওয়া উচিত নয়। শারীরিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। স্যানিটাইজার ব্যবহার বা সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। লকডাউন ও বিধিনিষেধ মেনে চলতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে প্রশাসনকে জোর খাটাতে হবে। কারণ দিনশেষে অবহেলার খেসারত তো সাধারণ মানুষকেই দিতে হবে।

চট্টগ্রামের প্রাক্তন সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, সীমান্ত দিয়ে মানুষের আসা-যাওয়া বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এর বাইরে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে মানুষকে সচেতন করতে হবে। প্রয়োজনে ওই এলাকাগুলোতে মাইকিং করতে হবে। রাজনৈতিক নেতা ও মসজিদের ইমামদের কথা মানুষ শোনেন। তাদের মাধ্যমে সচেতনতার বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। অনেকের আত্মীয়-স্বজন ভারতে থাকেন। তারা নিয়মিত ভারত-বাংলাদেশ যাওয়া-আসা করেন। এটা আপাতত বন্ধ করতে হবে।

তিনি বলেন, ভারতে করোনার সংক্রমণ বাড়ার পর থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে সতর্কতা বাড়ানো হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে সেভাবে সচেতনতা দেখা যাচ্ছে না। আমরা মাস্ক নিয়ে, স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে এত প্রচারণা চালালাম, অথচ ঈদে বাড়ি ফেরার সময় অনেকেই তা পাত্তাই দিলো না।

মাস্ক পরার বিষয়ে গ্রামের মানুষের অনীহার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, আমাদের সীমান্তবর্তী অনেক স্থানই গ্রামীণ এলাকায়। গ্রামের অনেক মানুষ এখনও মনে করে এটা শহরের রোগ। এটা ঠিক, গ্রামের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। তবে এখন গ্রামেও অনেক করোনা রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তাই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মসজিদের ইমাম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মিডিয়ার মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় সচেতনতা বাড়াতে হবে।

যারা করোনার টিকা নিয়েছেন তাদের ইমিউনিটির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, করোনা ভ্যাকসিন নিলেই যে শতভাগ সুরক্ষা নিশ্চিত হয়, এমন কিন্তু না। আপনি যদি টিকার দুটি ডোজই নেন, টিকা নেওয়ার দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর সাধারণত ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ইমিউনিটি হয়। তারপরও ২০ শতাংশ ঝুঁকি তো থেকেই যায়। আবার এটা যে সারাজীবনের জন্য নিশ্চয়তা দিচ্ছে তাও তো না। সুতরাং টিকা নিয়ে আপনি মোটামুটি ভালো একটা অবস্থানে থাকতে পারেন, তবে শতভাগ সুরক্ষায় আছেন এটি বলা যাবে না। তাই টিকা নিলেও মাস্ক পরতে হবে। টিকা নেওয়ার আগে যেভাবে চলতেন, সেভাবেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

দেশে করোনায় ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মৃত্যুহার বেশি। করোনায় এ বয়সী নারী-পুরষকে নিয়ে চিন্তাও বেশি। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, করোনা শুধু যে ফুসফুসে অ্যাটাক করে তা নয়, শরীরের যেকোনো দুর্বল জায়গা পেলে সেখানেও আক্রমণ করে। বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ, কিডনির রোগ, ব্লাড প্রেসার, স্ট্রোকসহ নানা জটিলতা থাকে। তাই তাদের শরীরের রোগাক্রান্ত অংশে করোনার আক্রমণও হয় বেশি। বয়স্ক মানুষদের মধ্যে অনেকে আবার দীর্ঘদিনের ধূমপায়ী। সবমিলিয়ে ভাইরাসটি তাদের এত জায়গায় আক্রমণ করে তারা সহজেই করোনায় কাবু হয়ে যান।

বয়স্ক মানুষদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও তুলনামূলক কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, একজন তরুণ যেভাবে করোনার ধকল সামলাতে পারেন, বয়স্ক ব্যক্তি সেভাবে পারেন না। এটাও বেশি বয়সের মানুষের করোনায় মৃত্যুর অন্যতম কারণ।

গত এক বছরে দেশে করোনায় মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। নারী ও পুরুষের মধ্যে মৃত্যুসংখ্যায় এই ব্যবধানের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, সারা পৃথিবীতেই এমনটি হচ্ছে। আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, দেশে মারা যাওয়া করোনা রোগীর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই পুরুষ।

তিনি বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে— নারীর শরীরে কিছু হরমোন থাকে। এসব হরমোন রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আবার পুরুষের তুলনায় নারীরা ধূমপান করেন কম। এটাও গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।

এছাড়া নানা কারণে নারীর তুলনায় পুরুষকে বেশি ঘরের বাইরে যেতে হচ্ছে। তাই করোনার ঝুঁকি, আক্রান্ত ও মৃতের তালিকায় পুরুষের সংখ্যাই বেশি। সোজা কথায় করোনা পরিস্থিতিতে যে যত ঘরে থাকবেন, তত নিরাপদ থাকবেন। এটাই আসল বিষয় —যোগ করেন তিনি।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!