‘প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর ভাঙচুর’—সামনেই ‘যুবলীগের বদি’

১৯৯৭ সালে কক্সবাজারে এক ঘূর্ণিঝড়ের পর গৃহহীন মানুষদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পর্যায়ক্রমে সে আশ্রয়ণ প্রকল্প ছড়িয়ে দেওয়া হয় সারাদেশে। ১৯৯৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে আড়াই লাখ পরিবারকে ঘর হস্তান্তর করেছেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে খুশি, আনন্দিত হন ঘরহারা মানুষেরা। কিন্তু এর মাঝে হঠাৎই সংবাদমাধ্যমে ওঠে আসে, প্রকল্প হস্তান্তরের আগেই ভেঙে পড়ছে এসব ঘর। অভিযোগ ওঠে, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় এসব ঘরে ফাটল দেখা দেয়, ভেঙে যায়।

আরও পড়ুন: যুবলীগ ‘নেতার কাণ্ড’—চট্টগ্রামে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করেই গ্রেপ্তার ঢাকায়

এমন অভিযোগে তদন্তের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তদন্ত করতে গিয়ে পাওয়া যায় অবাক করা তথ্য। এসব ঘর ভাঙচুরে জড়িত খোদ সরকার দলীয় নেতা! চট্টগ্রামের পটিয়ায় এমন এক অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গিয়ে ওঠে আসে কেন্দ্রীয় যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম বদির নাম। প্রশ্ন ওঠে, কার ইশারায় বদি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গেলেন?

বদির নেতৃত্বে ভাঙচুর

পটিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর ভাঙচুর ও নির্মাণসামগ্রী ভাঙচুরের ঘটনায় জেলা প্রশাসকের নির্দেশে থানায় জিডি করেন প্রকল্প কর্মকর্তা। জিডি পেয়ে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর ভাংচুরে বদি ও তার অনুসারীদের জড়িত থাকার চিত্র। এ ঘটনায় পুলিশ প্রসিকিউশন পাঠায় আদালতে। এতে অভিযুক্ত সবাই যুবলীগের বদির অনুসারী।

এছাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের নির্মাণসামগ্রী ভাঙচুরের একটি ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে সামজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যাতে দেখা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের নির্মাণসামগ্রী টয়লেটের রিং নিয়ে একটি পিকআপ যাওয়ার পথে আটকায় বদিউল আলম বদি। তার সঙ্গে ছিলেন একজন ক্যামেরামান এবং বেশ কয়েকজন অনুসারী। তারা কেউ মোবাইলে ভিডিও করছেন, আর কেউ ছবি তুলছেন।

এসময় ট্রাকে থাকা লোকজনকে টয়লেটের রিং বেশি উপর থেকে ফেলার জন্য চাপ দেওয়া হয়। তারা বেশি ওপর থেকে ফেললে ভেঙে যাবে, এটি নিচে নামানোর প্রক্রিয়ায় নামাতে চাইলেও হুঙ্কার দেন বদি নিজে ও তার অনুসারীরা। একপর্যায়ে বদি নিজেও একবার রিং ফেলে ভাঙতে এগিয়ে যায়। পরে তার অনুসারীরা পিকআপের উপর থেকে টয়লেটের রিং ফেলে ভেঙে চুরমার করে উল্লাস শুরু করে।

আরও পড়ুন: বিএনপিতে বাবা—যুবলীগে ছেলে, নেতার আড়ালে ‘সন্ত্রাসী’ সুজন

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে যুবলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম বদি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ‘নির্মাণসামগ্রী নিম্নমানের কিনা দেখা হয়েছে।’ নিম্নমানের কিনা তা দেখার দায়িত্ব ওনাকে কে দিয়েছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের স্থান পরিদর্শনের আগের দিন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আমাকে ফোন করেছিলেন।’

জিডি প্রসঙ্গে বদি বলেন, ভাঙচুরের ঘটনায় আমার অনুসারীরা মিথ্যা মামলার শিকার এবং কোনো ঘটনায় আমি সম্পৃক্ত নই।

জানা যায়, পটিয়ার বালু সাইফু, ভোলাসহ কয়েকজন অনুসারী এই ভাঙচুর চালায়। এ ঘটনা জানাজানি হলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে মামলার নির্দেশ দেন।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সুপ্তশ্রী সাহা পটিয়া থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে বলা হয়, ‘প্রকল্পের ঘর ভাঙচুর, মালামাল চুরির পাশাপাশি খোদাই করা প্রধানমন্ত্রীর নেইম-প্লেটও ভেঙে ফেলা হয়।’

পুলিশের তদন্তে বদির অনুসারী ভোলা এবং বালু সাইফু জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে। তদন্তের পর তাদের বিরুদ্ধে থানা থেকে আদালতে প্রসিকিউশন পাঠানো হয়। এরপর তারা আদালতে গিয়ে জামিন নেন।

ভাঙচুর মামলার আসামিদের ফুল দিয়ে বরণ

আসামিদের জামিনের জন্য বদি নিজেই পটিয়া আদালতে যান বলে অভিযোগ উঠে। জামিনের পর তাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেন যুবলীগের বদি আলম। পটিয়ার প্রধান সড়কে ‘বীরবেশে’ আচরণও দেখান আসামিরা।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বদিউল আলম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, যাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছি তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা আইসিটি মামলা দেওয়া হয়েছিল। আর কোনো কর্মী যদি মিথ্যা মামলা থেকে জামিন পায় তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিতেই পারে।

তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ১২ জুলাই রাত ১১টার পর আমাকে ফোন করেন। ওনার সঙ্গে প্রকল্পের বিষয়ে আমার কথা হয়েছে। কথা বলার পরদিনই সরেজমিন দেখতে গিয়েছিলাম। আশ্রয়ণ প্রকল্পে কী ধরনের নির্মাণসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে তা দেখার জন্য টয়লেটে রিংটা পরীক্ষা করে দেখেছি। রিংটাতে লোহার কোনো বস্তু ছিল না। খুব নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবকে খুদে বার্তার মাধ্যমে অবহিত করি।

বদি বলেন, দেখেন আমি জনগণের জন্য কাজ করি। প্রতিনিধি হওয়ার জন্য কাজ করি। আর জনগণের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব আমাদের। তাদের অধিকার রক্ষা করার দায়িত্বও আমাদের।

কেন এমন কাণ্ড বদির?

জানা গেছে, শুরু থেকেই পটিয়ার স্থানীয় রাজনীতিতে ভাগ বসাতে মরিয়া বদি। যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক থাকাকালে এলাকার রাজনীতিবিদদের সঙ্গে প্রকাশ্যে কোনো সম্পর্ক চোখে পড়েনি তাঁর। তখন বদি যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর অনুসারী ছিলেন। কিন্তু নতুন কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়ার পর থেকেই পটিয়ায় নিজের বলয় গড়তে থাকেন বদি।

আরও পড়ুন: যুবলীগ নেতা সেজে—সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড জিকুর, গুলি ছুড়েন ‘শোকের অনুষ্ঠানেও’

স্থানীয় রাজনীতিতে আধিপত্যের নামে হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর দুর্নাম রটাতে মরিয়া বলেও দাবি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের। পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা আলোকিত চট্টগ্রামকে জানান, পটিয়ার আধিপত্য বিস্তারের নামে হুইপকে বেকায়দায় ফেলতে নানা ষড়যন্ত্রের গুটি চালাচ্ছে এই বদি। এর অংশ হিসেবে সরকারবিরোধী প্রচারণা চালাতেই প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ও নির্মাণসামগ্রী ভাঙচুর করেছে। এর সুষ্ঠু বিচার হওয়া দরকার। জড়িত যেই হোক, যার অনুসারীই হোক বিচারের আওতায় আনা দরকার।

তারা অভিযোগ করেন, একটি বিশেষ শিল্পগ্রুপের সঙ্গে হুইপের পারিবারিক দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাতে চাচ্ছে বদি। কারণ কেন্দ্রীয় যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম পটিয়ার সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরী এমপি’র বিরোধীপক্ষ।

প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি

আশ্রয়ণ প্রকল্পের কিছু ঘর নির্মাণের পরপরই ভেঙে যাওয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কিছু লোক হাতুড়ি-শাবল দিয়ে ঘর ভেঙে গণমাধ্যমে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভার শুরুতে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।

ঘরভাঙার পেছনে দায়ীদের চিহ্নিত করা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যখনই ঘরভাঙার তথ্য পেয়েছি, সম্পূর্ণ সার্ভে করিয়েছি। কারা এর সঙ্গে জড়িত, প্রত্যেকের নাম-ঠিকানাসহ পেয়েছি।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!