পুত্র-নাতির দিশাহীন দৌড়, দেনায় গিলে খাচ্ছে ‘দাদা’র ইলিয়াস ব্রাদার্সকে

চট্টগ্রামের বনেদি ব্যবসায়িক পরিবারের একটি ইলিয়াস ব্রাদার্স (এমইবি গ্রুপ)। একসময়ের জনপ্রিয় এই ‘ব্র্যান্ড’ প্রতিষ্ঠানটি দুই প্রজন্মের ব্যবধানে এখন লোকসানে ধুঁকছে। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ কয়েকশ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

সম্প্রতি ঋণখেলাপির দায়ে প্রতিষ্ঠানের পাঁচ কর্ণধারের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন চট্টগ্রামের একটি আদালত। এর আগে ২০১৯ সালে আর্থিক লেনদেন সংশ্লিষ্ট অপর এক মামলায় গ্রেফতারও হয়েছিলেন এমইবি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সামসুল আলম।

জানা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ভাইকে নিয়ে ‘ইলিয়াস ব্রাদার্সে’র যাত্রা শুরু করেন মো. ইলিয়াস। এরপর ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে জায়গা করে নেয়।

সমস্যাটা শুরু হয় মূলত দ্বিতীয় প্রজন্মে এসে। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে নুরুল আবছার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ইলিয়াসের ছেলে মো. সামসুল আলম দায়িত্ব নেওয়ার পর খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে।

তৃতীয় প্রজন্মে এসে ইলিয়াসের নাতি ও সামসুল আলমের ছেলে শোয়েব রিয়াদ পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হন। এ সময়কালে খেলাপি ঋণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন বিনিয়োগে লোকসানের ধাক্কা।

সবমিলিয়ে এক প্রজন্মে জনপ্রিয় ব্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ইলিয়াস ব্রাদার্স দুই প্রজন্মের ব্যবধানে এখন দেনায় জর্জরিত লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ইলিয়াস ব্রাদার্সের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত উত্থান-পতনের গল্প জানতে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে বিভিন্ন সময় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সামসুল আলম ও তাঁর রাজনৈতিক অনুসারী, পরিচালক শোয়েব রিয়াদ, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা হয়। দীর্ঘ আলাপচারিতায় উঠে এসেছে চমক জাগানো উত্থান থেকে শুরু করে হতাশায় ভরা এক ‘পতনে’র গল্প।

যেভাবে উত্থান

মোহাম্মদ ইলিয়াস, চট্টগ্রামের ব্যবসায়িক জগতে পরিচিত এক নাম। স্বাধীনতার আগে বড় ভাই আহমদ হোসেনকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ইলিয়াস ব্রাদার্স। শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠানটির মূল বিনিয়োগ ছিল ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ে। এ খাতে স্বাধীনতার আগের সাফল্য অব্যাহত ছিল স্বাধীনতাপরবর্তী সময়েও।

একসময় প্রতিষ্ঠানটিকে মানুষ চিনত লিভার ব্রাদার্সের (বর্তমানে ইউনিলিভার) পরিবেশক হিসেবে। সেসময় চট্টগ্রামে লিভার ব্রাদার্সের প্রধান পরিবেশক হিসেবে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ে বেশ দাপট ছিল ইলিয়াস ব্রাদার্সের।

একপর্যায়ে লিভার ব্রাদার্সের সঙ্গে ব্যবসায়ের পাট চুকিয়ে বিভিন্ন উৎপাদনমুখী ব্যবসায়ে বিনিয়োগ শুরু করেন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা। একে একে জিপি/সিআই শিট, গ্লাস শিট, সয়াবিন তেল, কাগজ ও বোর্ড, তৈরি পোশাক, ব্রিকফিল্ডসহ বিভিন্ন শিল্পখাতে যুক্ত হয় ইলিয়াস ব্রাদার্সের নাম।

সাফল্য পেতেও সময় লাগেনি। ধীরে ধীরে চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপের একটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এমইবি গ্রুপ। বিশেষ করে ‘দাদা’ ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল ও মিনারেল ওয়াটার চট্টগ্রামে জনপ্রিয় পণ্য হিসেবে জায়গা করে নেয়। লাভের মুখ দেখতে থাকে অন্য ব্যবসাগুলোও।

তবে অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য ও তৃতীয় প্রজন্মে এসেও নগরের অভিজাত কোনো এলাকায় সরে আসেননি আহমদ হোসেন ও মোহাম্মদ ইলিয়াসের উত্তরসূরীরা। আলাদা বাড়ি ও ফ্ল্যাট থাকলেও নগরের বৃহত্তর বাকলিয়ার নুরনগর এলাকার সেই একই কম্পাউন্ডে এখনও একরকম একসঙ্গেই থাকছেন তারা। প্রতিষ্ঠানের মালিকানাতেও বিদ্যমান সেই যৌথ পরিবারের ধারা।

খেলাপি ঋণে জর্জরিত দ্বিতীয় প্রজন্ম

শুরুটা সাফল্যে জড়ানো হলেও ইলিয়াস ব্রাদার্সের অবস্থা সবসময় এক থাকেনি। বিশেষ করে ইলিয়াসের মৃত্যুর পর। নব্বইয়ের দশকে প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর পর দায়িত্বভার পুরোপুরি এসে পড়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের ওপর। মূলত এ প্রজন্মে এসেই লোকসানের গল্পটা শুরু।

দ্বিতীয় প্রজন্মে এসে ব্যবসা পরিচালনায় যুক্ত হন নুরুল আবছার ও সামসুল আলম। ব্যবসা সম্প্রসারণে একের পর এক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে শুরু করেন তারা।

কিন্তু ব্যবসায়ে তখন পুরোদমে লোকসান শুরু হয়ে গেছে। নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় নাম আসে ইলিয়াস ব্রাদার্সের কর্ণধারদের।

তৃতীয় প্রজন্মে যোগ লোকসানি বিনিয়োগ

তৃতীয় প্রজন্মে এসে ইলিয়াস ব্রাদার্সের হাল ধরার চেষ্টা করেন ইলিয়াসের নাতি শোয়েব রিয়াদ। নতুন কিছু প্রকল্পে বিনিয়োগ করেন তিনি। ব্যাংকেও বাড়ে ঋণের বোঝা।

প্রথমেই ‘দাদা’ ব্র্যান্ডের পণ্যগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণে মনোযোগী হন রিয়াদ। একপর্যায়ে কোমল পানীয় ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেন। শুধু কারখানাই নয়, ‘আইসি’ ব্র্যান্ডের কোমল পানীয়টির বিজ্ঞাপন ও প্রচারণার পেছনেও বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করা হয়। তবে বাজারে সাড়া ফেলতে পারেনি ‘আইসি’। একইসময়ে ব্যবসা কমেছে ‘দাদা’ ব্র্যান্ডেরও।

একপর্যায়ে ‘দাদা’ ব্র্যান্ডের বাজার সংকুচিত হয়ে আসে। তৈরি পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানাতেও বাড়ে লোকসান। আগের খেলাপি ঋণের সঙ্গে শোয়েব রিয়াদের সময় নতুন বিনিয়োগে যোগ হওয়া লোকসানের ধাক্কায় বর্তমানে রীতিমতো ধুঁকছে ইলিয়াস ব্রাদার্স।

এদিকে শোয়েব রিয়াদ এখন ‘নাহার গ্রুপ’ নামে অপর একটি ব্যবসায়িক গ্রুপের অধীনেও বেশ কিছু ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এমইবি গ্রুপের পরিচালকের দায়িত্বের পাশাপাশি নাহার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বও পালন করছেন রিয়াদ। তবে নাহার গ্রুপেও উল্লেখ করার মতো সাফল্যের খবর মেলেনি।

ব্যর্থ রাজনীতিতেও

ইলিয়াস ব্রার্দাসের দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি সামসুল আলমের হাত ধরে দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু হয় ইলিয়াস ব্রাদার্স পরিবারের। বাবার রাজনৈতিক যাত্রায় বড় অংশীদার ছিলেন ছেলে শোয়েব রিয়াদ।

তবে বাবা-ছেলের এই ‘প্রজেক্ট’ও সাফল্যের মুখ দেখেনি। প্রথমে বাকলিয়া-কোতোয়ালী আসনে আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনের টিকিট চেয়েছিলেন সামসুল আলম। মনোনয়ন না পেয়ে দল বদলে বিএনপিতে যোগ দেন। তবে টিকিট পেলেও ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নুরুল ইসলাম বিএসসির কাছে বড় ব্যবধানে পরাজিত হন সামসুল আলম।

বর্তমানে বিএনপির মাঠের রাজনীতিতেও আর আগের মতো সক্রিয় নন সামসুল আলম। একসময় নগর কমিটির সহসভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্যের দায়িত্বে ছিলেন। তবে এখন নগর কমিটিতেও গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে নেই তিনি।

মূল চ্যালেঞ্জ ঋণ পরিশোধ

চট্টগ্রামের আর্থিকখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইলিয়াস ব্রাদার্সের সামনে এখন মূল চ্যালেঞ্জ বিশাল অঙ্কের ঋণ পরিশোধ। আইনি জটিলতা ও যৌথ পরিবারের সমন্বয়ের বিষয়টি তো আছেই। পাশাপাশি লোকসানে চলতে থাকা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গতি ফিরিয়ে আনাও প্রতিষ্ঠানের কর্ণাধারদের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!