‘নালায় পড়ে ৫ মৃত্যু’ চউক—চসিকের রশি টানাটানি, বিব্রত আওয়ামী লীগ

চট্টগ্রাম নগরের অরক্ষিত নালায় পড়ে পাঁচজনের মৃত্যু ক্ষুব্ধ করে তুলেছে সাধারণ মানুষকে। নালায় পড়ে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন রশি টানাটানিতে বিব্রত আওয়ামী লীগও।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন— পরিকল্পিত উদ্যোগ না নিয়ে দুই সেবা সংস্থা চসিক ও সিডিএ একে অপরকে দুষছে। কড়া বক্তব্যও দিচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা যেন সরকারের বাইরে। এ অবস্থায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। এ ভাবমূর্তি ক্ষুন্নে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপকে দায়ী করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা।

এদিকে স্ল্যাব ও বেষ্টনীহীন অরক্ষিত নালায় একের পর এক ‘মৃত্যু’ ঘটলেও যথাযথ তদারকি নেই সংশ্লিষ্ট সংস্থার। বৃষ্টি হলেই নালাগুলো যেন হয়ে উঠে মানুষখেকো।

বৃষ্টি হলে জলজটে ডুবে থাকে রাস্তা। পানিতে একাকার হয়ে যায় নালা-ফুটপাত। দেখে বোঝার উপায় থাকে না কোনটি নালা, আর কোনটি ফুটপাত। এ কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণ। আর এ অবস্থার জন্য চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ দুই সেবা সংস্থা চসিক-সিডিএ  দায় চাপাচ্ছে একে অপরের ঘাড়ে।

এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, একে অন্যকে দোষারোপ না করে উভয় সংস্থারই উচিত দায়িত্বশীল কথা বলা। কারণ দায় সবারই রয়েছে৷ এই মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না সিডিএ কিংবা সিটি করপোরেশন কেউই। অথচ তারা একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর কাদা ছোড়াছুড়িতে ক্ষুন্ন হচ্ছে সরকারের ভাবমূর্তি।

আরও পড়ুন: ‘সাবধান’—জলাবদ্ধতায় ওঁৎ পেতে ৭ বিপদ

সোমবার (২৭ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টার দিকে চশমা কিনতে গিয়ে আগ্রাবাদে নালায় পড়ে মুহূর্তেই লাশ হন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সেহেরিন মাহবুব সাদিয়া। পাঁচ ঘণ্টার পর সেই লাশ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর জানা গেল, কয়েক টন আবর্জনা আর নালার ভেতর আরেকটি নালা থাকায় বেগ পেতে হয়েছে লাশ উদ্ধারে। তবে এ ঘটনার দায় নিতে রাজি নয় সিডিএ কিংবা চসিক।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র রেজাউল করিম বলেন, ড্রেন ময়লায় ভর্তি ছিল এটা সত্য। যেহেতু কাজ চলছে, সমস্ত ময়লা তো ওখানে গিয়ে পড়ছে। এখানে মেইনটেনেন্সের সব দায়িত্ব তো সিডিএর।

তিনি বলেন, ড্রেনে ময়লা আছে, কিন্তু ড্রেনের পাশে ঘেরা ছিল না, রেলিং ছিল না, সেগুলো থাকলে তো এই দুর্ঘটনাটা ঘটত না। এত বড় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে, ময়লা পড়বেই এখানে। কিন্তু আমাদের রেলিং ছিল, স্ল্যাবও ছিল, এগুলো তো সব কাজ করতে গিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে।

অপরদিকে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, তারা (চসিক) নালা পরিষ্কার করবে না, আবার কিছু ঘটলেই সিডিএর দোষ দেয়। সিডিএর দোষ ধরা ছাড়া মনে হয় সিটি করপোরেশনের আর কোনো কাজ নেই।

তিনি বলেন, ময়লা পরিষ্কার না করার কারণে সেখানে পানি কতটুকু ছিল বোঝা সম্ভব হয়নি। ভালোমতো পরিষ্কার করলে দুর্ঘটনা ঘটত না। তারপরও যে ঘটনা ঘটেছে সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত। এটার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। নিহতের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।

আরও পড়ুন: ৩৪ ঘণ্টায়ও খোঁজ মেলেনি ‘বৃষ্টির পানিতে’—ভেসে যাওয়া লোকের

এদিকে এই মৃত্যু নিয়ে দুই গুরুত্বপূর্ণ সেবা সংস্থার অবস্থানকে ভালোভাবে নিচ্ছে না নগরবাসী। একইসঙ্গে এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী। ক্ষোভের সেই বিস্ফোরণ ঘটেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যেখানে বলা হচ্ছে—চট্টগ্রামের উন্নয়নে রাস্তাঘাটের উন্নয়নসহ সহ ফ্লাইওভার করা হচ্ছে। চলছে কর্ণফুলী টানেলের মতো প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। কিন্তু এসব উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও নগর দেখভালের দায়িত্বে থাকা চসিক, সিডিএ, ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা, অবহেলা ও উদাসীনতায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।

সেবা সংস্থাগুলো সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও উঠে আসে—বেষ্টনী ও স্ল্যাব ছাড়া নালা ও খালে কেউ পড়ে মারা যাওয়ার পর শুরু হয় একে অন্যের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা। দায়িত্বশীলদের এমন বক্তব্যে বদনাম হয় সরকারের। অথচ বন্দর নগরীর উন্নয়নে বর্তমান সরকারের চেষ্টার ত্রুটি নেই। নালার ওপর স্ল্যাব না থাকা, খাল-নালা নিয়মিত পরিষ্কার না করাসহ পর্যাপ্ত সড়কবাতির অভাবেই এমন মৃত্যু হচ্ছে বলেও অনেকে অভিযোগ করেন।

চসিকের তথ্য অনুযায়ী, পুরো নগরে প্রায় ৯৪৬ কিলোমিটার নালা রয়েছে। এছাড়া নগরের আওতাধীন ৫৭টি খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬১টি কিলোমিটার। এই ৯৪৬ কিলোমিটার নালার কী পরিমাণ খোলা আছে তার কোনো তথ্য নেই সিটি করপোরেশনের কাছে।

অন্যদিকে ৫৭টি খালের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানেও নেই নিরাপত্তা বেষ্টনী। যেকারণে নালা ও খালে ডুবে মরছে মানুষ।

নগরের অধিকাংশ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মানুষের চলাচল পথের পাশে অধিকাংশ নালার ওপর কোনো স্ল্যাব নেই। বৃষ্টির সময় নগর পানিতে তলিয়ে গেলে কোথায় ফুটপাত, কোথায় নালা আর কোথায় সড়ক তা বোঝার কোনো উপায় থাকে না।

গেল সপ্তাহে চাক্তাই এলাকায় নালায় পড়ে মারা যান এক ভবঘুরে। এর আগে গত ২৫ আগস্ট সকালে ভারী বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা হলে মুরাদপুর এলাকায় খালে পড়ে তলিয়ে যান সালেহ আহমদ নামে এক সবজি ব্যবসায়ী। এখন পর্যন্ত তার খোঁজ মেলেনি।

চলতি বছরের ৩০ জুন নগরের ষোলশহর এলাকায় চশমা হিল খালের পাশের সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় সিঁড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে একটি অটোরিকশা খালে পড়ে যায়। স্রোত থাকায় খালে পড়ে তলিয়ে মারা যান অটোরিকশা চালক সুলতান (৩৫) ও যাত্রী খাদিজা বেগম (৬৫)।

আরও পড়ুন: বৃষ্টির পানিতে ডুবে ‘অটোরিকশা’ পড়ল খালের ১৫ ফুট নিচে, নিহত ২

এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নঈম উদ্দিন চৌধুরী আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর দায় কেউ এড়াতে পারেনা। আমিসহ সকলের দায়িত্ব রয়েছে। নগরের দেখভাল সংস্থাগুলোর অবহেলা, উদাসীনতা ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার কারণে এই মৃত্যু। এটাকে মৃত্যু না বলে হত্যা বলা উচিত। এজন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনা দরকার। সরকারের ব্যাপক উন্নয়নের পরও কিছু লোকের অবহেলা ও লাগামহীন কথাবার্তার কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। এর দায় এড়ানোর সুযোগ কারো নেই।

একই প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সীমান্ত তালুকদার বলেন, সেবা সংস্থাগুলোর অবহেলায় এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। এর দায় কেউ এড়াতে পারে না। সেবা সংস্থাগুলোর দায়িত্ব এড়ানোর বক্তব্য কাম্য নয়। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। এছাড়া দলীয় বিভেদ ভুলে নগরের উন্নয়নে সবাইকে একত্রিত হওয়া জরুরি।

যোগাযোগ করা হলে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মাহমুদুল হক আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স সড়কগুলো কেটে চৌচির করে ফেলছে। কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এই দুর্ভোগ ও মৃত্যু। এই মৃত্যুর দায় কেউ এড়াতে পারে না। এ বিষয়ে দায় এড়ানোর বক্তব্যে সরকার ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।

এসি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!