ভেঙে ‘চার টুকরো’—চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগ, দুলছে নেতাদের কলঙ্কের ভারে

ছাত্রলীগের সংবিধানে আছে— বিবাহিত, অছাত্র, চাকরিজীবী কিংবা ব্যবসায়ী কেউই ছাত্রলীগের নেতা হতে পারবেন না। কিন্তু চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ চলছে সংবিধানের ঠিক উল্টো পথে। মেয়াদোত্তীর্ণ নগর ছাত্রলীগের ২৯১ সদস্যের কমিটিতে ১৬২ জনই অছাত্র! আর ৫৬ জন ইতোমধ্যে বিয়ে করে সংসার করছেন।

এদিকে নগর ছাত্রলীগে চলছে আবার চার সতীনের লড়াই। অর্থাৎ চার কাণ্ডারির অনুসারীতে বিভক্ত চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের নেতারা। এখানে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের অনুসারীদের একটি গ্রুপ রয়েছে। আবার মহিউদ্দিন চৌধুরী অনুসারীদের রয়েছে তিনটি গ্রুপ! আগে দুই গ্রুপের অবস্থান স্পষ্ট থাকলেও কয়েকদিন আগে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় মহিউদ্দিন গ্রুপ।

মহিউদ্দিন অনুসারী সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির নেতৃত্বে নগর ছাত্রলীগে একটি শক্তিশালী গ্রুপ রয়েছে। নগর ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরের নেতৃত্বে রয়েছে আরেকটি গ্রুপ। সম্প্রতি ওয়ার্ড কমিটি গঠন নিয়ে ‘পাল্টা কমিটি’ ঘোষণা নিয়ে প্রকাশ্যে এসেছে যুগ্ম সম্পাদক গোলাম সামদানী জনির নেতৃত্বে নতুন গ্রুপ। এই গ্রুপে মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী বেশকিছু ছাত্রলীগ নেতাও রয়েছেন।

আরও পড়ুন: চমেক বন্ধ হলো ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে, হল ছাড়তে হবে শিক্ষার্থীদের

নুরুল আজিম রনি পদত্যাগের পর যুগ্ম সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পর থেকেই নিজেদের ইচ্ছেমতো বিভিন্ন ওয়ার্ডে ‘পকেট কমিটি’ করার অভিযোগ রয়েছে নগর ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। গুঞ্জন আছে, এমইএস কলেজের সাবেক এক ছাত্রনেতার ইঙ্গিতেই চলছেন সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর। নগরের ওয়ার্ড কমিটির বেশিরভাগেই ওই নেতার অনুসারীদের স্থান দেওয়া হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো কমিটিতে নুরুল আজিম রনির অনুসারীদের একেবারেই রাখা হচ্ছে না। এছাড়া সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু মহিউদ্দিন চৌধুরী অনুসারী হলেও মূলত চলছেন খোরশেদ আলম সুজনের ছায়া—মায়ায়।

দুই কাণ্ডারির বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

নগর ছাত্রলীগের দুই কাণ্ডারি— সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর। এই দুই কাণ্ডারির বিরুদ্ধে জমেছে অভিযোগের পাহাড়। স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অস্ত্রবাজদের কমিটিতে স্থান দেওয়া, ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করাসহ অজস্র অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। গত ১৮ ডিসেম্বর চাঁদাবাজির অভিযোগে পুলিশের হাতে আটক হন ২৫নং রামপুরা ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন বাবু।

এর আগে ৯ ডিসেম্বর নগরের নাসিরাবাদের একটি ‘মধুকুঞ্জ’ থেকে একাধিক তরুণীসহ পুলিশের জালে ধরা পড়েন পাঁচলাইশ থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আব্দুল আল আহাদ। এর আগের মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে এক প্রবাসীর ২৭ ভরি স্বর্ণ মেরে দেওয়ার অভিযোগে নগরের পাঁচলাইশ থানা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক জহিরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

১৭ নভেম্বর প্রকাশ্যে দিনদুপুরে রাস্তায় প্রতিপক্ষকে কোপান নগর ছাত্রলীগ সদস্য ওয়াহিদ আলম ওয়াহিদ। চাঁদার টাকা নিয়েই দিনদুপুরে প্রকাশ্য সড়কে আরিফ নামের এক যুবককে চাপাতি দিয়ে কোপান ওয়াহিদ। এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নিন্দার ঝড় উঠে।

আরও পড়ুন: দোষ স্বীকার করে জরিমানায় মুক্ত নারীসহ গ্রেপ্তার সেই ছাত্রলীগ নেতা

৩১ আগস্ট বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ ফেনীতে র‌্যাবের হাতে আটক হন নগর ছাত্রলীগের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন এবং পাহাড়তলী থানা ছাত্রলীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক তানভিরুল ইসলাম সাজু।

গত এক বছরে নগর ছাত্রলীগের অন্তত ১৫ জন পদধারী নেতা বিভিন্ন অপরাধে আটক হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। এর মধ্যে শুধু একজন ছাড়া অভিযুক্ত আর কোনো নেতার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো কারো কারো হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদ!

যেমন কাজী নাঈম নামের এক কর্মীর বিরুদ্ধে মহসীন কলেজে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ব্যানার ছেঁড়ার প্রমাণ রয়েছে। অথচ শাস্তির বদলে তিনি পান মহসীন কলেজ ছাত্রলীগের ‘আহ্বায়ক’ হওয়ার পুরস্কার! আবার ছাত্রলীগের নেতা হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকার পরও অনেককে দেওয়া হয়েছে ‘পদ’ উপহার। হালিশহর থানা ছাত্রলীগের কমিটিতে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা এক যুবলীগ কর্মীকে ছাত্রলীগের সদস্য বানানো হয়েছে! আবার সেই কমিটিতেই স্থান হয়েছে এমন একজনের যিনি সম্প্রতি ফিরেছেন মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে!

ক্ষোভের অনলে পুড়ছে ছাত্রলীগ

ছাত্রলীগ নেতাদের অপরাধে জড়ানোর জন্য সভাপতি ইমরান হোসেন ইমু এবং সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরকে দায়ী করেছেন খোদ কমিটিরই কয়েকজন নেতা। ইমু-দস্তগীরের বিপক্ষে প্রকাশ্যে অনাস্থা জানিয়ে ইতিপূর্বে বিবৃতি দেন কমিটির ৪৬ জন পদধারী নেতা। এ কমিটিকে অকার্যকর ও মেয়াদউত্তীর্ণ দাবি করে মিছিল-সমাবেশও হয়েছে বহুবার। সবমিলিয়ে ক্ষোভের অনলে পুড়ছে ছাত্রলীগ।

নগর ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম সামদানী জনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, স্বেচ্ছাচারিতা ও একনায়কতন্ত্রের কারণে ছাত্রলীগে অযোগ্যরা নেতা বনে যাচ্ছে। ইমু-দস্তগীর নিজেদের আজ্ঞাবহদের নেতা বানাতে গিয়ে ছাত্রলীগের মধ্যে একটা বিভাজন তৈরি করেছে।

আরও পড়ুন: রাতেই রক্ত ঝরল ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বে, আতঙ্ক ছড়াচ্ছে নাহিদ—কায়সার গ্রুপ

নগর ছাত্রলীগের সহসভাপতি রেজাউল আলম রনি বলেন, নিজেকে ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দিতে লজ্জা হয়। কারণ আমাদের ছাত্রত্বই নেই। অনেকে আবার বিয়ে করে বাচ্চা নিয়ে সংসার করছে। নতুনদের হাতেই ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেওয়া উচিত।

এদিকে সভাপতি ইমু সাহেব বিবাহিত বলে মন্তব্য করেন নগর ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওয়াহেদ রাসেল। অপর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঈনুর রহমান বলেন, একদশক ধরে পদবিটা ধরে আছি, লজ্জা লাগে। বুঝি না ইমু-দস্তগীরের কেন এই বোধটা আসে না?

এর আগে কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপসম্পাদক নাছির উদ্দীন কুতুবী বলেছিলেন, চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের ২৯১ সদস্যের কমিটির ৫৬ জন বিবাহিত, ১৬২ জনই অছাত্র!

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!