মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আশ্রয়ের পাঁচ বছর পূর্ণ আজ বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট)। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাদের নির্যাতন ও নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। গত পাঁচ বছরে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের দেখে গেছেন অনেক আন্তর্জাতিক সেলিব্রিটি ও সংস্থা।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয় বাংলাদেশ। কিন্তু গত পাঁচ বছরেও সমস্যা সমাধানে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে আসেনি কোনো দেশ। যেকারণে সমস্যা সমাধানে কোনো সঠিক আলোর রশ্মির দেখা মিলছে না।
এদিকে হালে রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়েছে নানা অপরাধে। ব্যবহার হচ্ছে টার্গেট কিলিংয়ে। পাশাপাশি প্রতিনিয়ত ঘটাচ্ছে ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাইরে খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, গুম, অস্ত্র, মাদক, স্বর্ণ ও মানবপাচারের মতো গুরুতর অপরাধ কর্মকাণ্ড। ফলে কক্সবাজার জেলাজুড়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় ক্যাম্পে বর্তমানে ১১ লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা বসবাস রয়েছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক একাধিক চুক্তি অনুযায়ী এতদিনে অধিকাংশ রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার কথা। কিন্তু গত পাঁচ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমার ফেরত নেয়নি। ফলে বাংলাদেশও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক মারপ্যাচের কবলে পড়ে কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার চুক্তি সই করে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রত্যাবাসন শুরু করতে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ (জেডব্লিউজি) গঠন করা হয়। মিয়ানমার-বাংলাদেশ জেডব্লিউজ’র সর্বশেষ ও পঞ্চম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় চলতি বছরের ১৪ জুন।
মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব ইউ থান ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দ্রুত সময়ে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ঐক্যমত পোষণ করেছিলেন।
এদিকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৭ সালের নভেম্বর ও ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে উখিয়ার ঘুমধুম সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের তংপিউ লেটওয়ে স্থল ট্রানজিট দিয়ে সপ্তাহে ১৫০ জন ও টেকনাফের হ্নীলার বিপরীতে মিয়ানমারের নাগা খুইয়ে ট্রানজিট দিয়ে সপ্তাহে ৩০০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু তা এতদিনে বাস্তবায়ন হয়নি।
অভিযোগ আছে, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিওগুলোর পরোক্ষ ইন্ধনে রোহিঙ্গাদের একটি সশস্ত্র গ্রুপ প্রত্যাবাসনে বিরোধিতা করে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জোরালো ভূমিকা নেওয়া রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মহিবুল্লাহকে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ খুন করে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের তথ্যমতে, দুষ্কৃতিকারী রোহিঙ্গারা খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মানবপাচার, অগ্নিসংযোগসহ ১৪ ধরনের অপরাধে জড়িত। এসব অপরাধের কারণে ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত দেড় হাজারের অধিক মামলা হয়েছে।
পুলিশের সূত্রমতে, সর্বশেষ গত ১০ আগস্ট দিবাগত রাতে উখিয়ার ১৫ নাম্বার জামতলী ক্যাম্পে সশস্ত্র সন্ত্রাসিদের গুলিতে খুন হন দুই রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা)। নিহতরা হলেন— ওই ক্যাম্পের ১৫ সি-১ ব্লকের আব্দুর রহিমের ছেলে হেড মাঝি আবু তালেব (৪০) এবং সি ৯ ব্লকের ইমাম হোসেনের ছেলে সাব ব্লক মাঝি ছৈয়দ হোসেন (৩৫)।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সবচেয়ে আলোচিত খুনের ঘটনা ঘটেছিল গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে। ওই রাতে রোহিঙ্গাদের জনপ্রিয় নেতা ও আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মাস্টার মুহিবুল্লাহকে সশস্ত্র আরসা গ্রুপের সদস্যরা খুন করে। এ ঘটনায় ৩২ জন আরসা সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়েছিল। এর মধ্যে ১২ জনের খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন বলে জানিয়েছেন সদ্য বদলি হওয়া ১৪ এপিবিএন পুলিশের অধিনায়ক নাইমুল হক। এ আলোচিত খুনের ঘটনার পরপরেই ১৮ নম্বর ক্যাম্পের একটি মাদ্রাসার ছয় ছাত্র-শিক্ষককে একসঙ্গে খুনের ঘটনা ঘটে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে উখিয়ায় ২১টি ও টেকনাফে ১৩টিসহ ৩৪টি ক্যাম্পে রেকর্ড ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসবাস। উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে ৮ ও ১৪ এবং টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান বা এপিবিএন পুলিশ। গত দেড় বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর সার্বিক নিরাপত্তার চিত্র উদ্বেগজনক।
৮ এপিবিএন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ মাস ধরে তারা উখিয়ার ১১টি ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করছে। এসময়ে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ১৭ লক্ষাধিক পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে। একইসময়ে বিদেশি পিস্তলসহ ধারালো অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে ১৯১টি। এছাড়া ৯১ ভরি চোরাই স্বর্ণ, ৬৫ লক্ষাধিক নগদ টাকা, ৩ লক্ষাধিক মিয়ানমার কিয়াট এবং ৮১ হাজার ৫০০ বাংলাদেশি জাল নোট উদ্ধার করা হয়।একই সময়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা আদায় করা হয় ১০ লাখ ৭৫ হাজার ৬৬৫ টাকা।
ক্যাম্পের দায়িত্বে নিয়োজিত ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদ্য বদলি হওয়া অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) মো. সিহাব কায়সার খান পিপিএম বলেন, মাদক, অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধী আটক কার্যক্রম জোরদার করে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এপিবিএন দৃঢ়ভাবে কাজ করছে।
স্থানীয় কুতুপালং এলাকার ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় মোট জনসংখ্যার দ্বিগুণের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। প্রতি বছর নতুন জন্ম নেওয়া প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা যোগ হচ্ছে ক্যাম্পে। পাশাপাশি বাড়ছে অপরাধ কর্মকাণ্ড। আজ ২৫ আগস্ট এদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাবাসনে আলোর মুখ না দেখায় স্থানীয়দের মাঝে হতাশা ও চরম ঝুঁকি বিরাজ করছে।
এদিকে সব ধরনের অপরাধের পাশাপাশি বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে মানবপাচার। জল ও স্থলপথের পাশাপাশি পাচারকারীরা আকাশপথকে বেছে নিয়েছে। ২৩ আগস্ট বিকেলে পাচারকারীরা ১১ জন রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার থেকে ঢাকা হয়ে আকাশ পথে অন্য দেশে পাচারের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে আটক হয়। পরে তাদেরকে থানায় সোর্পদ করা হয়।
এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মো. সেলিম উদ্দিন বলেন, বিমানবন্দর থেকে আটক করা ১১ রোহিঙ্গার মধ্যে মানবপাচারকারীও রয়েছে। যারা পাচারের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে মামলা হয়েছে।
মানবপাচার নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যে দেড় হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব ও উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, সবচেয়ে উৎকন্ঠার বিষয় রোহিঙ্গারা নানা অবৈধ কারবারের সঙ্গে জড়িয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, বিভিন্ন স্থানে কাজের সন্ধানে গিয়ে বিয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশিদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। যা খুবই বিপদজনক।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ১৯৭৮, ১৯৯০- ৯১, ২০১০, ২০১২, ২০১৬ ও সর্বশেষ ২০১৭ সালে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ইতোমধ্যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। গড়ে তুলছে জেলার বিভিন্ন এলাকায় আত্মীয়তাও। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ গড়ে তুলেছে বড় বড় প্রাসাদও। সুতারাং যতই দিন যাচ্ছে আমরা ততই ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছি।
এদিকে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার সামছুদ্দোজা নয়ন জানান, আজ ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে এদেশে সর্বশেষ আশ্রয় নিয়েছিল ১০ লাখের অধিক রোহিঙ্গা। তাই এই দিনকে ঘিরে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে দোয়া ও আলোচনা সভার আয়োজন করতে পারে। তবে ক্যাম্পে দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মাঝি রয়েছেন। এই মাঝিরাই সাধারণত রোহিঙ্গাদের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। এই বিষয়টি নিয়ে তাদের সাথে কথা হচ্ছে। যদি আয়োজন হয়ে থাকে তাহলে খুবই সীমিত পরিসরে হবে।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে আরও খবর পড়ুন