চট্টগ্রামে প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভাসিয়ে একের পর এক মেয়র আসেন। তবে নগরবাসীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনও বর্ষায় নগরবাসীকে ভাসতে হয় জলে। নগরের অসংখ্য এলাকার মানুষকে দিনের পর দিন থাকতে হয় পানিবন্দী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামবাসীর সবচেয়ে বড় শত্রু জলাবদ্ধতা। সামান্য বৃষ্টি হলেই নিম্নাঞ্চলে জমে যায় হাঁটুপানি। আর টানা বৃষ্টি হলে অলি-গলি ছাড়িয়ে রাজপথও ডুবে যায় পানিতে। এবারের তুমুল বর্ষণে ঠিক এমনটিই হয়েছে। নগরজুড়ে এখন ভয়াবহ জলজট। বাসা-বাড়ি থেকে রাজপথ সবখানেই পানি আর পানি। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে এর সমাধান দিতে ব্যর্থ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)।
সরেজমিন দেখা গেছে, ভারী বর্ষণে ডুবে গেছে নগরের নিম্নাঞ্চল। বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে চান্দগাঁও, বাকলিয়া, মোহরা, বাদুরতলা, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, চকবাজার, বহদ্দারহাট, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, মিয়াখান নগর, খাজা রোড, বাস টার্মিনাল, প্রবর্তক মোড়, মুরাদপুর, মেহেদীবাগ, ষোলশহর, ২ নম্বর গেইট, হালিশহরসহ অজস্র এলাকা। নগরজুড়ে কমে গেছে গণপরিবহন। জলজটের কারণে অনেক এলাকায় রিকশাই এখন প্রধান ভরসা!
বহদ্দারহাটের বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আয়ান বলেন, এমন কোনো বছর নেই যে বছর জলবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি চট্টগ্রামাবাসীকে। আর কয়টা মেয়র এলে, আর কয়টা প্রকল্প হলে জলাবদ্ধতার নিরসন হবে— প্রশ্ন করেন তিনি।
কথা হয় ২ নম্বর গেটের বাসিন্দা ইশফাক চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ঘরজুড়ে বৃষ্টির পানি। শুলকবহর-বহদ্দারহাট পানির জন্য অফিসেও যেতে পারছি না। জানি না কখন এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো?
আরও পড়ুন : চট্টগ্রামজুড়ে ভয়াবহ জলজট, চউকের ঘাড়েই দায় চাপাচ্ছে চসিক
এদিকে বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে খোদ মেয়রের বাড়িও। গতকাল (শনিবার)) রিকশায় চেপে ঘরে ফিরেছেন মেয়র। রিকশায় চেপে মেয়রের ঘরে ফেরার ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল।
সূত্র জানায়, নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকায় চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তিন সংস্থা—চউক, চসিক ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তিন সংস্থার সমন্বয়হীনতায় এখনও বৃষ্টির জলে ডুবছে নগর।
২০১৭ সালের আগস্টে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। এরপর ২০২২ সালে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৯ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা করা হয়। সর্বশেষ চার হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয় এ প্রকল্পের। চউক এ প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা হলেও নির্মাণকাজ করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। কাজটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের জুনে। পরে তা বাড়িয়ে চলতে বছরের জুন পর্যন্ত করা হয়। সর্বশেষ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। নগরের ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টির কাজ করা হয় এই প্রকল্পের অধীনে। বাকি ২১টি টারশিয়ারি খালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চসিকের।
এদিকে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চউকের প্রকল্পের কাজ ৭৬ দশমিক ২৫ শতাংশ শেষ হয়েছে দাবি করা হলেও কমেনি জলাবদ্ধতা। যোগাযোগ করা হলে জলাবদ্ধতা অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক ও চউকের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, বাড়াইপাড়া থেকে কর্ণফুলী খালের ২০১২ সালের প্রকল্পটি এখনো শেষ করতে পারেনি চসিক৷ জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের ৩৪ ব্রিগেড। তারা ৩৬টির মধ্যে ২০টির কাজ শেষ করেছে। বাকি ১৬টি এখনো শেষ হয়নি, এ কারণেই পানি জমছে।
তিনি বলেন, বাকি ১৬টি খালে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু না করায় সেগুলোতে রিটেনিং ওয়ালের নির্মাণকাজ আটকে আছে। ফলে জমা থাকা বৃষ্টির পানি নামতে পারছে না। খালের উভয় পাড়ে ভূমি অধিগ্রহণ হলে আমরা রিটেনিং ওয়াল নির্মাণ করতে পারবো। তখন পানি চলাচলের রাস্তা সুগম হবে।
জমি অধিগ্রহণের জন্য আরও প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বরাদ্দ এলে কাজ দ্রুত শেষ হবে। আর যেসব স্লুইস গেট নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলোর কাজও এখনো পরিপূর্ণভাবে শেষ হয়নি।
তিনি আরও বলেন, সংকট নিরসনে দুটি প্রকল্পের আওতায় কর্ণফুলী নদীর মুখে ১৭টি স্লুইস গেট নির্মাণ করছে চউক। এর মধ্যে ১২টি নির্মিত হচ্ছে কালুঘাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত সড়ক বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায়। বাকি ৫টি নির্মিত হচ্ছে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায়। ওই ১২টির মধ্যে ১০টির কাজ শেষ। এর মধ্যে চাক্তাই ও রাজাখালীসহ ৫টি স্লুইস গেট এ বছর চালু হবে। মেগা প্রকল্প ও চউকের প্রকল্পের আওতায় থাকা ১৭টি স্লুইস গেট একসঙ্গে চালু হলে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ অনেকটা কমে আসবে।
প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস অভিযোগ করে বলেন, নগরের নালা–নর্দমাগুলো ঠিকভাবে পরিষ্কার করেনি চসিক। এ কারণে জলজট আরও বেড়েছে।
এদিকে জলাবদ্ধতার দায় নিতে নারাজ চসিক। মেয়রের একান্ত সচিব ও চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মু. আবুল হাশেম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, প্রকল্প শেষ না হলে পরিপূর্ণ সুফল পাওয়া যাবে না৷ যেসব এলাকা ডুবে গেছে সেই এলাকার পানিগুলো কোনদিক দিয়ে যায়? পানিগুলো যায় চাক্তাই খাল দিয়ে। স্লুইস গেটগুলোও চিকন হয়ে গেছে। স্লুইস গেটের সামনে আইল্যান্ডের মতো পলি জমে আছে। এ মাটিগুলো যদি না তোলা হয় তাহলে তো হবে না।
তিনি বলেন, বাকলিয়া এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য আমরা প্রজেক্ট করেছি। বাড়াইপাড়া খালের সেই প্রজেক্টের কাজ ২০২৪ সালের শেষদিকে সম্পন্ন হবে। এটি ২০১২ সালের প্রকল্প হলেও ফিজিক্যাল কাজ শুরু হয়েছে এক বছরের মতো হবে। জমির দাম বৃদ্ধির কারণে দেরি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, চাক্তাই খালসহ যেসব খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন হবে ওই খালগুলোতে এখন ওভারফ্লো। যদি এমন হতো খালগুলোতে স্পেস আছে, কিন্তু উপর থেকে পানি যাচ্ছে না তাইলে একটা কথা ছিল। পানিগুলো খালে গিয়ে নদীতে স্লোলি যাচ্ছে। খালের যে প্রশস্ততা-গভীরতা কমে গেছে এর পুরো দায় চউকের।
আরও পড়ুন : পানিতে ভাসছে চট্টগ্রাম, তুমুল বৃষ্টিতে বাড়ছে পাহাড়ধসের ভয়
আবুল হাশেম বলেন, খালের জায়গা ছোট করে রাস্তা করা হয়েছে৷ আগে যে খাল ছিল ৪০ ফিট ছিল সেটাকে ২০ ফিট করে ১০ ফিট রাস্তা করেছে। ফলে খাল হয়ে গেছে ৩০ ফিট৷ ১৩ লাখ কিউবিক ফিট মাটি তোলার কথা থাকলেও ২ লাখ কিউবিক ফিটও মাটি তোলা হয়নি। যে পরিমাণ মাটি তোলার কথা সে পরিমাণ মাটি তুললে তো ১০-২০ টা পাহাড় হয়ে যেত। মাটিগুলো গেল কই? যদিও দাবি করে ঠিকভাবে তুলেছে।
তিনি বলেন, চউক ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে দাবি করলেও আমরা সেটা বিশ্বাস করি না। ফিজিক্যালি মনিটরিং হলেও নিশ্চিত হওয়া যাবে কত শতাংশ কাজ হয়েছে। ৩৬টি খাল চউকের অধীনে। ২১টি টারশিয়ারি ড্রেন আমাদের, যেগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ এবং অস্তীত্বহীন হয়ে গেছে। ৫৭টি খাল দিয়ে বে অব বেঙ্গল এবং কর্ণফুলীতে পানি প্রবাহিত হয়৷ এরমধ্যে একটিভ এবং লাইন খাল যেগুলো ছিল সেগুলোতে তারা কাজ করছে। বাকি ২১টি খালের কোনোটা শাখা খাল হয়ে গেছে, আবার কোনোটি বিলীন হয়ে গেছে। খালগুলো অনুসন্ধান করছি, আছে কি-না বা কী পরিমাণ দখল হয়েছে। ফিজিক্যাল স্টাডির প্রকল্প নিয়েছি। নদীতে পানি যায় চউকের ৩৬টি খাল দিয়ে৷ সেগুলো একটিভ হলে ৯০ শতাংশ সমস্যার সমাধান হবে।
আলোকিত চট্টগ্রাম