চট্টগ্রামে মাছ-আলু বিক্রেতা গলায় সাংবাদিকের কার্ড ঝুলিয়ে চাঁদাবাজি, রেহাই পাচ্ছে না পুলিশও
বন্দর-পতেঙ্গায় ঘুরছে ভুয়া সাংবাদিকের দল
চট্টগ্রাম নগরের বন্দর-পতেঙ্গা এলাকায় বেড়েছে ভুয়া সাংবাদিকের দৌরাত্ম্য। বিভিন্ন ভুঁইফোড় অনলাইন পোর্টাল ও অননুমোদিত আইপিটিভির নাম দিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা। সেই সঙ্গে ‘প্রেস’ লেখা আইডি কার্ড ও স্টিকার লাগিয়ে করছে চাঁদাবাজি।
চাঁদাবাজি কিংবা তদবির বাণিজ্যে ব্যর্থ হলেই পুলিশকেও হয়রানির ছক আঁকেন তারা। এই ছক থেকে রেহাই পাচ্ছেন না থানা পুলিশও। ঘায়েল করতে থানা পুলিশের বিরুদ্ধে এসএমএসের মাধ্যমে মিথ্যা অভিযোগও যাচ্ছে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কর্তাদের মোবাইলে। এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্তারা।
তবে এসব কথিত সাংবাদিকের অপতৎপরতা রোধে পুলিশ সর্তক রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিএমপির উপকমিশনার (বন্দর) শাকিলা সুলতানা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষাগত যোগ্যতা বা সংবাদ লিখতে না জানলেও নামসর্বস্ব কিছু অনলাইন ও পত্রিকার কার্ড কিনে রাতারাতি সাংবাদিক হয়ে গেছেন অনেকে। তাদের চাঁদাবাজি, অপপ্রচারে মানুষ যেমন বিভ্রান্ত হচ্ছে, তেমনি অবনতি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। এতে মূলধারার সাংবাদিকদের পাশাপাশি বিব্রত স্থানীয় প্রশাসনও।
জানা গেছে, এক সময়ের আনসার সদস্য, গার্মেন্টসকর্মী, থানার সোর্স, ফুটপাতে আলু বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা ও বিভিন্ন কোম্পানির সেলসম্যান হিসেবে যারা কাজ করতেন তারা এখন সাংবাদিক। সকাল-বিকাল বন্দর ও পতেঙ্গা এলাকার অলিগলিতে ঘুরে বেড়ান তারা। জুয়া, মাদক, পতিতাবৃত্তি, চোরাকারবারিসহ বিভিন্ন অবৈধ স্পট থেকে মাসোহারা আদায়, যখন-তখন ভিডিও ধারণ করে ফেসবুক পেইজে প্রচারের নামে মানুষকে জিম্মি করা তাদের প্রতিদিনের কাজ। পরে সেই লেখা ও ভিডিওকে পুঁজি করে চলে চাঁদা আদায়।
কবির হোসেন নামে স্থানীয় একজন জানান, বন্দর-পতেঙ্গায় ১৫/২০ জনের একটি চক্র আছে, যারা নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে। তাদের কারো শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দেন। মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করাই তাদের মূল টার্গেট। তারা ভুলে ভরা কিছু নিউজ করে যাতে অভিযুক্ত কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেন বক্তব্য থাকে না। যেনতেনভাবে প্রতিবেদন করে মানুষকে মানহানি, বিভ্রান্ত ও জিম্মি করে। পরে সেই প্রতিবেদনকে পুঁজি করে মোটা অংকের টাকা আদায় করে।
তিনি আরও জানান, আমি নিজেও একজন ভুক্তভোগী। কোথাকার একটি ভিডিওতে ছবি প্রচার করে সমাজ ও পরিবারের কাছে আমাকে হেয় করেছে রিয়াজ ও মোস্তাফিজ নামের দুই ভুয়া সাংবাদিক। পরে সেই ভিডিও সরিয়ে নেওয়ার কথা বলে মোটা অংকের টাকা দাবি করে তারা।
আবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তি জানান, পেশায় আমি একজন রিকশাচালক। রিয়াজ, মোস্তাফিজসহ চারজন সাংবাদিক আমাকে টাকা দিয়ে একটি পতিতালয়ে পাঠায়। এ সময় আমাকে বলে, তারা সেখানে গিয়ে খদ্দর হিসেবে আমাকেসহ ভিডিও করবে এবং ওই ঘরের মালিক থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করবে। সেখান থেকে আমাকেও কিছু টাকা দেবে। কোনো টাকাতো আমাকে দেয়নি বরং কয়দিন পর দেখলাম ‘নগরনিউজবিডি’ নামের একটি পেইজে আমার ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন লজ্জায় আমি কাউকে মুখ দেখাতে পারি না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে নগরনিউজবিডি’র মালিকের মুঠোফোন (০১৭৯৬০৯৫৬০) যোগাযোগ করা হলে তিনি নিজের নাম-পরিচয় দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আপনারা নিউজ করেছেন, আরও করেন। আমি মামলা করবো। আমরা কাউকে ব্ল্যাকমেল করি না, করেছি এমন কেউ বলতে পারবে না।
পেজে নিউজ করার কোন অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার পেজে নিউজ করার অনুমোদন আছে কিনা আপনার জানার দরকার নেই। কারও জানার দরকার হলে তারা জানবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও ওনারা মানুষকে জিম্মি করতে পটু। আইনের শাসন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক সময় আমাদের (পুলিশ) কঠোর হতে হয়। এতে সকলের কল্যাণ হলেও অপরাধীরা অসন্তুষ্ট হয়। কিন্তু এখানে দেখা যায়, এসব ভুইফোড় সাংবাদিকদের অনেকে অপরাধীদের পক্ষ নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন অফিসারদের কাছে আজেবাজে লিখে (উড়ো চিঠি) পাঠান। তাদের কারণে কাজ করতে গিয়ে আমাদের বিব্রত হতে হয়।’
স্থানীয়রা জানান, বন্দর-পতেঙ্গা এলাকায় ভুয়া সাংবাদিকদের একটি চক্র রয়েছে। যারা সংঘবদ্ধভাবে নানা অপকর্ম করে। এদের মধ্যে আছেন- রিয়াজ (একসময় সোর্স ও ফুটপাতে আলু বিক্রি করতেন), মোস্তাফিজ (একটি কোম্পানির সেলসম্যান), মোস্তাফা (একাধিক নারী নির্যাতন মামলার আসামি), জীবন (র্যাবের সোর্স), দর্জি ইলিয়াছ, কবির বৈদ্য, হালিম, ফারুক বৈদ্য, নাছির, ইমরান, খাইরুল, ভিডিওম্যান মাসুম, শাহিন (টমটম ড্রাইভার), নয়ন (মাছ বিক্রেতা) ও বেলাল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, এরাতো সাংবাদিক না, এরা টাউট। এদের কারণে অনেক সময় থানার ওসিও বিব্রত হয়ে পড়েন। অধস্তন অফিসাররা এসব ভুয়া সাংবাদিকের খপ্পরে পড়ে কিছু অভিযান করে নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেন। এতে স্থানীয়ভাবে প্রশাসন বিতর্কিত হয়। একপর্যায়ে এর দায় পড়ে থানার ওসিসহ থানা পুলিশের ওপর।
যোগাযোগ করা হলে সিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি-পোর্ট) শাকিলা সুলতানা আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, কিছু অসাংবাদিকের আনগোনার খবর আমরা শুনছি। এদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসব কথিত সাংবাদিকের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
আলোকিত চট্টগ্রাম