ছোট কিংবা বড় যেকোনো বয়সের মানুষেরই টিকা নিতে থাকে ভয়। আর সেটি যদি হয় বিশেষ কোনো রোগ প্রতিরোধের কিংবা কোনো ক্যাম্পেইনের তাহলেই সবার আগে সামনে আসে সেই টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ আরো কত কী? আবার এ টিকা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও যদি সমানে চলে অপপ্রচার ও গুজব তবে তা নিয়ে অনেকেই ভোগেন শঙ্কায়।
তবে এবার সব শঙ্কা ও গুজবকে পেছনে ফেলে পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা হাসিমুখে নিয়েছে জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে বিনামূল্যে হিউম্যান পেপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) টিকা। এ যেন ভয়কে জয় করার আনন্দ।
বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবার) সকালে নগরের ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে দেখা গেল এমন চিত্র।
আরও পড়ুন : জরায়ুমুখ ক্যানসার—টাকা ছাড়াই চট্টগ্রামে মিলবে টিকা, গুজবে কান নয়
সরেজিমন দেখা গেছে, টিকার কার্ড নিয়ে লাইন ধরে স্কুলভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে নিচতলায় নেমে আসছে শিক্ষার্থীরা। শ্রেণি অনুযায়ী আলাদা তিনটি রুমে ঢুকছে শিক্ষার্থীরা। ঢুকেই ক্লাসরুমে বসে পড়ল একে একে। এরপর একজন একজন করে স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে এসে নিচ্ছে টিকা। টিকা দিয়ে বের হতেই শিক্ষার্থীদের পাশে ছুটে আসছেন অভিভাবকরা। করছেন সেবা-শ্রুশ্রুষা।
এদিকে টিকা দেওয়ার সেই মুহূর্তটি অনেকেই ধারণ করেছে মুঠোফোনে। ফটোসাংবাদিকরাও ছিলেন ব্যস্ত। আবার টিকা নেওয়া শিক্ষার্থীরা বাইরে এসে তুলল দলবেঁধে ছবি। এছাড়া স্কুল প্রাঙ্গণে রাখা বড় বড় প্রচারণার বোর্ডের সামনে ছবিও তুললেন অনেকে। তদশিক্ষার্থীদের এমন আনন্দের স্মৃতিতে বাদ যায়নি বাইরে অপেক্ষায় থাকা অভিভাবকরাও। কেউ ছবির সঙ্গী হয়েছেন, আবার কেউ ছবি তুলে দিয়েছেন হাসিমুখে।
ক্লাসরুম থেকে টিকা দিয়ে বের হওয়া ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী অনুভূতি প্রকাশ করে বলে, শুরু থেকে একটু ভয়ে ছিলাম। কিন্তু টিকা দেওয়ার পর সেই ভয় একেবারে কেটে গেছে। সামান্য পিঁপড়ার কামড়ের মতো মনে হয়েছে। এছাড়া আর তেমন কিছুই হয়নি।
স্কুলে উপস্থিত নাসরিন নামের একজন অভিভাবক বলেন, সবাই আনন্দের মাধ্যমে টিকা নিতে দেখে ভালো লাগছে। প্রায় দুঘন্টা ধরে চলছে কার্যক্রম। কারো কোনো সমস্যা চোখে পড়েনি। আমার মেয়েও নিয়েছে, ভালো আছে। অপপ্রচার ও গুজবের কারণে শুরুতে শঙ্কা থাকলেও এখন আর নেই।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) অধীনে ৭টি কেন্দ্রে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ১২ হাজার ৩৭১ জন শিক্ষার্থী প্রথমদিন টিকা নিয়েছে। এছাড়া ১৫ উপজেলায় টিকা নিয়েছে ২৮ হাজার ২৭৩ জন শিক্ষার্থী। তবে টিকা গ্রহণকারীদের কারো কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
চসিক সূত্রে জানা যায়, নগরের আগ্রাবাদ, বন্দর, দেওয়ানবাজার, কাপাসগোলা, মেমন, পাঁচলাইশ ও উত্তর কাট্টলী এলাকার ৭টি কেন্দ্রে মোট ১২ হাজার ৩৭১ জন শিক্ষার্থী এইচপিভি টিকা নিয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির ২ হাজার ৬১৯ জন, ষষ্ঠ শ্রেণির ২ হাজার ৯১০ জন, সপ্তম শ্রেণির ৩ হাজার ১২৬ জন, অষ্টম শ্রেণির ২ হাজার ১৭৮ জন এবং নবম শ্রেণির ১ হাজার ৫৩৮ জন।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৫ উপজেলার মধ্যে আনোয়ারায় ১ হাজার ৭৬১ জন, বাঁশখালী ১ হাজার ৮৭৪ জন, বোয়ালখালী ২ হাজার ৫১ জন, চন্দনাইশ ২ হাজার ১৪২ জন, ফটিকছড়ি ৩ হাজার ১১৩ জন, হাটহাজারী ৯৪৩ জন, কর্ণফুলী ১ হাজার ৬০২ জন, লোহাগাড়া ১ হাজার ৪৬৪ জন, মিরসরাই ২ হাজার ৪৫৫ জন, পটিয়া ১ হাজার ৫৬৭ জন, রাঙ্গুনিয়া ১ হাজার ৮৩২ জন, রাউজান ১ হাজার ৭৪৩ জন, সন্দ্বীপ ১ হাজার ৮২৪ জন, সাতকানিয়া ২ হাজার ২৮০ জন এবং সীতাকুণ্ডে ১ হাজার ৬২২ জন শিক্ষার্থী টিকা নিয়েছে।
এদিকে আজ সকালে ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের জরায়ুমুখ ক্যান্সারের টিকা ক্যাম্পেইনের উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী।
এতে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম ।
বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. অং সুই প্রু মারমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নূরে আলম সিদ্দিকী, চসিকের প্রধান নির্বাহী শেখ তৌহিদুল ইসলাম, বিভাগীয় পরিচালক (পরিবার পরিকল্পনা) শাহনাজ পারভীন, জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ফরিদা খানম, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা পরিচালক ড. গাজী গোলাম মাওলা, চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম, ইউনিসেফের হেলথ অফিসার দেলোয়ার হোসেন এবং চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইমাম হোসেন রানা।
অন্যদিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা আজিম হাকিম উচ্চ বিদ্যালয়ে জেলা পর্যায়ের মাসব্যাপী জাতীয় এইচপিভি টিকাদান ক্যাম্পেইনের উদ্বোধন করেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম।
কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুমা জান্নাতের সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন কর্ণফুলী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ. প. কর্মকর্তা ডা. নাজনীন সুলতানা, উপজেলা জেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এমওডিসি ডা. শাহাদাত হোসেন ও চরপাথরঘাটা আজিম হাকিম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মঞ্জুর আলম।
চসিকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইমাম হোসেন রানা আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, এইচপিভি টিকার প্রথমদিন ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। এদিন ৭টি কেন্দ্রে মোট ১২ হাজার ৩৭১ জন শিক্ষার্থী টিকা নিয়েছে। এসময় টিকা গ্রহণকারী কারো কোনো সমস্যা হয়নি। প্রতিটি কেন্দ্রে আমাদের মেডিকেল টিম, চিকিৎসক এবং ভলান্টিয়ার প্রস্তুত ছিল। আশা করি বাকিদিনগুলো এভাবেই সম্পন্ন হবে। কাল ও পরশু (শুক্র-শনিবার) টিকা কর্মসূচি বন্ধ থাকবে। রোববার সকাল থেকে পুনরায় শুরু হবে। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৬ হাজার কিশোরীকে টিকার আওতায় আনা। আশা করি আমরা সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারবো।
আরও পড়ুন : চট্টগ্রামে কিশোরীরা পাবে বিনামূল্যে এইচপিভি টিকা—যখন যেভাবে পাবে
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় ২৮ হাজার ২৭৩ জন শিক্ষার্থী নির্ভয়ে টিকা নিয়েছে। এসময় কারো কোনোরকম সমস্যা হয়নি। অনেকটা উৎসবমুখর পরিবেশে টিকা ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে। আশাকরি শেষ পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে এবং আমরা আমাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সক্ষম হবো।
তিনি বলেন, আজ থেকে শুরু হওয়া এ ক্যাম্পেইন চলবে মাসব্যাপী। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর সাড়ে ৩টা পর্যন্ত চলবে এ কার্যক্রম। ১৭ ডিজিটের জন্মনিবন্ধনের মাধ্যমে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন এবং জন্মনিবন্ধনবিহীন কিশোরীদেরকে হোয়াইট লিস্টিংয়ের মাধ্যমে ক্যাম্পেইনের প্রথম ১০ দিন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থায়ী টিকাদান কেন্দ্রসমূহে এবং পরবর্তী ৮ দিন স্থায়ী ও অস্থায়ী কেন্দ্রসমূহে টিকা দেওয়া হবে। কোনো কিশোরী যাতে এ টিকা থেকে বাদ না পড়ে সেদিক বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, জেলার ১৫ উপজেলার ৪ হাজার ৩৮৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণির ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৩৩০ জন কিশোরী ও স্কুলবহির্ভূত কমিউনিটির ৭ হাজার ৫১৮ জন কিশোরীসহ মোট ৩ লাখ ৫১ হাজার ৮৪৮ জন এবং সিটি করপোরেশন এলাকার প্রায় ১ লাখ ৩৬ হাজার কিশোরীকে এইপিভি টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আলোকিত চট্টগ্রাম