চকবাজারের ‘অস্ত্রবাজ’ টিটুর হঠাৎ ‘সন্ত্রাসী’ টিনু হওয়ার গল্প

মা-বাবা আদর করে শিশুকাল থেকেই তাকে ডাকত টিটু নামে। একে-২২ রাইফেল নিয়ে গ্রেফতার হয়ে এই টিটু জেলে যান ২০০৩ সালে। জেল থেকে বেরিয়ে হঠাৎ নাম বদলে যায় টিটুর।

রাতারাতি টিটু হয়ে যান টিনু। অনেকের ধারণা, একে-২২ রাইফেলের মামলাটি লোকচক্ষুর আড়ালে নিতেই টিটু থেকে টিনু হয়েছেন তিনি।

এই হলো—চট্টগ্রামের আলোচিত সন্ত্রাসী নূর মোস্তফা টিনুর নাম বদলের রহস্য। চকবাজার এলাকায় যিনি পরিচিতি গড়ে তোলেন ‘টিনু ভাই’ নামে।

একসময়ের মোটর ওয়ার্কশপ কর্মচারী টিনুর হাত থেকে কখনো উদ্ধার হয় নাইন এমএম পিস্তল, কখনো এচজ-২২ রাইফেল। কখনো পুলিশের হাতে, কখনো র‍্যাবের জালে ধরা পড়েন তিনি। সরকারের ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে বছরের উপর কারাগারে থাকা টিনু ছিনতাইয়েও দক্ষ। চাঁদাবাজিতেও বেশ সুনাম আছে তাঁর। যে রাজনৈতিক দলকে ‘হাতিয়ার’ করে টিনুর এত অপকর্ম সেই দলের নেতাকর্মীদের উপরও তিনি নিয়মিত চালান হামলা। অবাক করার বিষয়, টিনু নামেই যিনি চকবাজারে ‘কুখ্যাত’, ২০০৩ সালে অস্ত্র উদ্ধার মামলার চার্জশিটে উঠে আসে তাঁর আসল নাম। ‘টিটু’ নামেই দেওয়া হয় চার্জশিট।

২০০৩ সালের ২৮ এপ্রিল। গোয়েন্দা পুলিশের কাছে খবর আসে, একে-২২ একটি রাইফেল নিয়ে কয়েকজন সন্ত্রাসী যাবে চট্টগ্রামের গোলপাহাড় মোড় এলাকা হয়ে। গোপন এই সংবাদের ভিত্তিতে অপারেশনে নামে গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন এসআই মহিউদ্দিন সেলিমের নেতৃত্বে একটি দল।

রাত সাড়ে ১০টার দিকে গোলপাহাড় এলাকার কফি-ইন রেস্টুরেন্টের সামনে থেকে একে-২২ রাইফেলসহ নুর মোস্তফা টিটুকে (প্রকাশ টিনু) গ্রেফতার করে পুলিশ।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ওই সময় জানিয়েছিল, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে টিনু সে সময় জড়িত ছিলেন না। তার পেশা ছিল অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করা। বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র পাচারের কাজ করতো টিনু।

ভারি অস্ত্রসহ গ্রেফতারের পর ‘অস্ত্রবাজ পরিচিতি’ ঢাকতে টিটু নাম বদলে নিজের নাম প্রচার করতে থাকেন টিনু নামে।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক বিবেচনায় এ মামলা প্রত্যাহারের তদবির চালায় টিনু। কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায়ের তদন্তে উঠে আসে—কোনো রাজনৈতিক কারণে টিনুর বিরুদ্ধে এই অস্ত্র মামলা দায়ের হয়নি। যেকারণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে-২২ এর মতো ভারি অস্ত্রসহ গ্রেফতার হওয়া টিনুর মামলা প্রত্যাহার করেনি।

এদিকে এই মামলাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে ছাত্রলীগের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায় টিনু। পুরো চকবাজার এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে টিনু বাহিনী। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ব্যবসার পাশাপাশি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়ান টিনু। টিনুকে ‘মেন্টেন’ না করলে চকবাজার এলাকায় যেন ছাত্রলীগ করতে মানা! এর বাইরে ছাত্রলীগ করলে তাকে সহ্য করতে হয় টিনু বাহিনীর নির্যাতন।

টিনুর ভাই শিপুকে চকবাজার থানা ছাত্রদলের সভাপতি হওয়ায় বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়েও টিনুর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

পরবর্তীতে নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন টিনু। গড়ে তোলেন অপরাধের রাজ্য। যদিও তার অপকর্মে বিরক্ত হয়ে পরবর্তীতে টিনুর উপর থেকে ছায়া সরিয়ে নেন বিএসসি।

এদিকে ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে শুদ্ধি অভিযানে র‍্যাবের হাতে অস্ত্রসহ আটক হয়েছিল কিশোর গ্যাং লিডার নূর মোস্তফা টিনু। চকবাজার কাপাসগোলা এলাকা থেকে একটি বিদেশি পিস্তলসহ তাকে আটক করে র‌্যাব-৭। পরে তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী বাসায় তল্লাশি চালিয়ে একটি শর্টগান ও ৬৭ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।

এক বছর চার মাস এই মামলা কারাগারে থাকার পর চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি অস্থায়ী জামিনে মুক্তি পান টিনু। এরপর আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি। চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের উপর হামলা চালিয়ে সম্প্রতি ফের আলোচনায় আসেন টিনু।

সর্বশেষ রোববার (২০ জুন) র‍্যাবের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেফতারের মামলায় নুর মোস্তফা টিনুর জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন চট্টগ্রামের আদালত। মহানগর দায়রা জজ ৪র্থ আদালতের বিচারক আফরোজা জেসমিন কলি এই আদেশ দেন।

গত ২৩ মে অস্ত্র মামলায় টিনুর জামিন বাতিল করে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন হাইকোর্টের আপিল বিভাগ। আর সেই নির্দেশে রোববার আত্মসমর্পণ করে পুনরায় জামিনের আবেদন করলে আদালত তা নাকচ করে টিনুকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

আলোকিত চট্টগ্রাম

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm