চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে একটি প্রাইভেটকার ভাঙচুর ও হামলার ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে। পুলিশের দেওয়া মামলার চার্জশিটে নিরপরাধ ১১ ব্যক্তিকে ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসছে এলাকার মানুষ। এছাড়া পুলিশি তদন্ত নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
জানা যায়, ২০২৪ সালের ২২ অক্টোবর চরলক্ষ্যা এলাকায় একটি প্রাইভেটকার ভাঙচুর ও যাত্রীদের মারধরের অভিযোগে রেজাউল করিম (৫০) নামে এক ব্যক্তি থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে হামলা হয়েছে। এ ঘটনায় ২৭ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
এদিকে মামলার ৩২ দিনের মধ্যে পুলিশের দেওয়া চার্জশিটে কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক চৌধুরী এবং যুবলীগ নেতা তারেক হাসান জুয়েলসহ বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার নাম আসামির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে এলাকায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
মামলার আসামিরা হলেন— মো. ইকবাল (৩৩), দেলোয়ার হোসেন সাইদি (৩১), ইয়াছিন আরাফাত (৩৪), মো. আরমান হোসেন (২৫), আব্দুল্লাহ আল নোমান (২৬), আব্দুল্লাহ আল সুমন (২৭), আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩২), মো. রুবেল (৩৫), মো. ফয়সাল (২১), মো. আবছার (২৪), মো. নয়ন (২৫), মো. মনির (৩০), মো. শাহজাহান (৩৫), শাহ জামাল (৩২), মো. মামুন (৩১), মো. তাহের (৫৮), মো. সোহেল (২৭), হাসমত (৪৫), আজম খান (৪৫), জসিম উদ্দিন (৫০), মো. রফিক (৬০), ফারুক চৌধুরী (৫৫), হায়দার কবির আইনান (২৫), তারেক হাসান জুয়েল (৩৫), মো. বাহাদুর খান (৩০), গিয়াস উদ্দিন মধু (৩২) ও মোক্তার হোসেন হিরু (৩৫)। সব আসামি কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বাসিন্দা ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী।
এদিকে ওইদিনের ঘটনার পর কর্ণফুলী থানা পুলিশের এসআই মো. বেলায়েত হোসেন মো. ইকবাল, মো. দেলোয়ার হোসেন সাইদি , মো. আরমান হোসেন ও মো. আবছারকে চরলক্ষ্যা থেকে গ্রেপ্তার করেন। এরপর গ্রেপ্তার ৪ জনকে আদালতে হাজির করে জামিন আবেদন করা হলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ষষ্ঠ আদালতের বিচারক কাজী শরীফুল ইসলামের আদালত জামিন মঞ্জুর করেন।
অন্যদিকে মামলার পর নানা আলোচনা ও সমালোচনার মুখে বাদী রেজাউল করিম গত ৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের চিফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১১ জনের নাম চার্জশিট থেকে বাদ দিতে আবেদন করেন।
আবেদনে বাদী উল্লেখ করেন, এগারো জন ব্যক্তি আসামি নয় এবং পুলিশ ভুলভাবে তাদের আসামি করেছে। তিনি এই ব্যক্তিদের এজাহার থেকে বাদ দেওয়ার জন্য আদালতের নির্দেশ চান। যদিও আদালত এ আবেদনে কোনো মন্তব্য না করে তা নথিভুক্ত করেন।
আরও পড়ুন : চট্টগ্রামে শিশু খুন—ভবন মালিককে ফাঁসাতে গিয়ে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে ৩ খুনিকে
এদিকে একই ঘটনার জের ধরে বাদি রেজাউল করিম আদালতে দ্রুত বিচার আইনে আরও একটি মামলা করেন। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কর্ণফুলী থানার এসআই মো. বেলায়েত হোসেন। তিনি তাড়াহুড়ো করে ৩০৭ ধারায় ও জসিম উদ্দিন (৫০) নামে এক আসামিকে বাদ দিয়ে ২৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। আদালতে বাদীর আবেদনের পরেও চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেই ১১ জনকে। তারা হলেন— ইয়াছিন আরাফাত, হাসমত, আজম খান, জসিম উদ্দিন, ফারুক চৌধুরী, হায়দারুল কবির ইনান, মো. রফিক, তারেক হাসান জুয়েল, মো. বাহাদুর খান, গিয়াস উদ্দিন মধু ও মোক্তার হোসেন হিরু।
এ বিষয়ে বাদী রেজাউল করিম বলেন, পুলিশ নিরাপরাধ ব্যক্তিদের নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। এতে তার দেওয়া তথ্য-প্রমাণ উপেক্ষা করা হয়েছে। পুলিশের দায়িত্ব ছিল সঠিকভাবে তদন্ত করা। কিন্তু তারা বাদির বক্তব্য উপেক্ষা করে চার্জশিটে নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে।
এদিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই বেলায়েত হোসেন বলছেন, বাদীপক্ষ কোনো ধরনের যোগাযোগ বা সহযোগিতা করেনি।
তদন্ত কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন আদালতের কাছে বেঞ্চ সহকারীর মাধ্যমে একটি অবহিতকরণ প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, একই ঘটনা নিয়ে একাধিক মামলা করা আইনগতভাবে সমীচিন নয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(২) অনুসারে কোনো অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে একাধিকবার ফৌজদারিতে সোপর্দ ও দণ্ডিত করা যাবে না। অথচ এসব মামলায় আইন লঙ্ঘন করে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন বাদী।
আরও উল্লেখ করা হয়, পুলিশের দায়িত্ব ছিল নিরপেক্ষ তদন্ত এবং বাদির বক্তব্য গুরুত্ব দেওয়া। বাদি নির্দিষ্ট আসামিদের বাদ দেওয়ার কথা বলেছিলেন, যা তদন্তের ভিত্তি হতে পারতো। তবে চার্জশিটে তাড়াহুড়ো ছিল অগ্রহণযোগ্য। এসব মামলায় সময় নিয়ে তদন্ত করা প্রয়োজন ছিল।
অন্যদিকে একই ঘটনার রেশ ধরে ৭ বছর আগের একটি হত্যা মামলার সাক্ষীদের প্রাইভেটকার চাপা দিয়ে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে গত বছরের ৪ নভেম্বর মামলা করা হয়। চট্টগ্রাম ষষ্ঠ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরিফুল ইসলামের আদালতে মামলাটি করেন উপজেলার চরলক্ষ্যা ৬ নম্বর ওয়ার্ডের লাইল্যার বাপের বাড়ির মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী (৩১)।
আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে অভিযোগটিকে সরাসরি এজাহার হিসেবে গণ্য করতে সিএমপি কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) আদেশ দেন।
মামলার আসামিরা হলেন— চরলক্ষ্যা ৬ নম্বর ওয়ার্ডের গোয়ালপাড়া এলাকার রেজাউল করিমের ছেলে ইমরান হোসেন বাবলু (৩৪), একই এলাকার রবিউল হোসেন (২৪), রেজাউল করিম (৫৫), মো. হাসান (৩০), মাঈনুল ইসলাম (৩৪) ও নুরুল আলম খোকন (২৫)।
এজাহার সূত্রে জানা যায়, মামলার বাদী দেলোয়ার হোসেন সাঈদী আসামি ইমরান হোসেন বাবলুর বিরুদ্ধে ৭ বছর আগে সংঘটিত একটি হত্যা মামলার সাক্ষী ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদী রেজাউল করিম তদন্ত কর্মকর্তার ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আমি তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছি নিরপরাধ আসামিদের চার্জশিট থেকে বাদ দিতে। কিন্তু তিনি তা করেননি।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কর্ণফুলী থানার নবাগত ওসি মু. শরীফ বলেন, আমি যোগদানের পর শুধু চার্জশিট অগ্রবর্তী করেছি। এর বাইরে কিছু জানি না।
পরে যোগাযোগ করা হলে কর্ণফুলী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনির হোসেন বলেন, বাদী যাদের নাম দিয়েছেন তাদের নামেই মামলা হয়েছে। তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাদের নাম বাদ দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তদন্ত প্রক্রিয়ায় সেই স্বচ্ছতা দেখা যায়নি।
জেজে/আলোকিত চট্টগ্রাম