কুড়িয়ে পেয়েও অসহায় ‘মা’ ফিরিয়ে দিলেন বিচারকের টাকা

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি কিডনি রোগে আক্রান্ত মেয়ে। প্রয়োজন উন্নত চিকিৎসার। কিন্তু ইতোমধ্যে মেয়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিজের সব সঞ্চয় হারিয়েছেন কর্ণফুলীর বড়উঠান ইউনিয়নের শাহমীরপুর গ্রামের মোছাম্মৎ শাহিদা আকতার।

শাহিদা এমন দুর্দশায় থাকলেও লোভ যে তাকে স্পর্শ করতে পারেনি সেটা বুঝিয়ে দিলেন কুড়িয়ে পাওয়া ১৮ হাজার ৫৭২ টাকার ব্যাগ ফেরত দিয়ে।

সপ্তাহ দুয়েক আগের ঘটনা। চমেক হাসপাতালে মেয়ের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন শাহিদা। পথে হঠাৎ চোখে পড়ল একটি ব্যাগ। হাতে নিয়ে খুলতেই ব্যাগের ভেতর দেখলেন টাকাসহ মূল্যবান কাগজপত্র। এমন অবস্থায় কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। একদিকে অর্থসংকট আবার অন্যদিকে ব্যাগের কোনো মালিক নেই। নিশ্চয় তার মতোই কোনো রোগীর স্বজন হারিয়ে ফেলেছেন ব্যাগটি।

সেই ভাবনা থেকেই ব্যাগের ভেতরে থাকা কাগজ হাতিয়ে একটি নম্বরে ফোন দিলেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু অপরপ্রান্ত থেকে কোনো উত্তর নেই। এভাবে আরো কয়েকবার ফোন দিলে অবশেষে কেউ একজন কলটি রিসিভ করেন। পরে শাহিদাও কাগজপত্রের সঙ্গে যাবতীয় তথ্য মিলিয়ে নিশ্চিত হন ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তিই ব্যাগের আসল মালিক। এরপর মনে অন্যরকম প্রশান্তি পায় সে।

অবশেষে মঙ্গলবার (২২ জুন) কর্ণফুলী থানা পুলিশের মাধ্যমে ব্যাগের প্রকৃত মালিক চট্টগ্রাম জেলা দায়রা আদালতের যুগ্ম জজ মুনতাসির রাসেলের কাছে টাকাসহ মূল্যবান কাগজপত্র হস্তান্তর করেন শাহিদা।

মোছাম্মৎ শাহিদা আকতার বলেন, মেয়ের চিকিৎসার জন্য তখন টাকার প্রয়োজন ছিল। আর সে মুহূর্তে ব্যাগটি কুড়িয়ে পাই। খুলে দেখি ব্যাগটিতে টাকা ও কাগজপত্র রয়েছে। পরে ভাবলাম, মেডিকেলেতো কেউ এমনি আসেন না। নিশ্চয় আমার মতো কোনো রোগীর স্বজন ব্যাগটি হারিয়ে ফেলেছে। এরপর ব্যাগে থাকা কাগজ থেকে নম্বর নিয়ে ফোন দিই। বেশ কয়েকবার কল করার পর রিসিভ করেন এক ব্যক্তি। এরপর কাগজপত্রের সঙ্গে যাবতীয় তথ্য মিলিয়ে নিশ্চিত হই তিনিই ব্যাগটির আসল মালিক। তখনই মনে শান্তি আসে। পরে কর্ণফুলী থানা পুলিশের সহযোগিতায় উনার ব্যাগ ফিরিয়ে দিই।

ব্যাগটি পেয়ে বুধবার (২২ জুন) সন্ধ্যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘ওয়ালেট এবং মহানুভবতা’ শিরোনামে পোস্ট দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন যুগ্ম জজ মুনতাসির রাসেল। পোস্টে তিনি লেখেন, ‘আব্বার অসুস্থতার কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই নিয়মিত মেডিকেলে যেতে হয়েছে। এরমধ্যে ১৫ দিন আগে সন্ধ্যায় মেডিকেলের গেটে আমার ওয়ালেট হারিয়ে ফেলি। ওয়ালেটে বেশ কিছু নগদ টাকার সঙ্গে আমার আইডেন্টিটি কার্ড, জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ক্রেডিট কার্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট ছিল। ধরেই নিয়েছি, পিকপকেট হয়েছে। সাথে সাথেই হাসপাতলের পুলিশ ফাঁড়ি ইনচার্জ ইন্সপেক্টর জহির সাহেবকে জানালে তিনি পাঁচলাইশ থানায় জিডি করার ব্যবস্থা করেন এবং দেখেন সিসিটিভি ফুটেজ। কিন্তু মিলেনি কোন হদিস। কলসেন্টারে ফোন করে ক্রেডিট কার্ড উইথহেল্ড করি। পুলিশ কর্তৃপক্ষ উনাদের নিজস্ব তদন্ত চালিয়ে যান। কিন্তু আমার ওয়ালেটের সন্ধান আর পাইনি। আব্বা কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরে উনাকে বাসায় নিয়ে আসি।’

তিনি আরো লেখেন, আজ (মঙ্গলবার) দুপুরে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় এক ভদ্রমহিলা আমার পরিচয় জানতে চান। আমি উনার পরিচয় জিজ্ঞেস করাতে নাম বলেননি। বারবার আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। পরে কিছুটা বিরক্ত হয়েই আমার নাম বলেছি। জিজ্ঞেস করলেন, আমার কিছু হারিয়েছে কিনা। মানিব্যাগ হারিয়েছে জানালাম। তিনি কিছু প্রশ্ন করে আমার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে নিজের নাম-ঠিকানা জানালেন।

কর্ণফুলী থানার শাহমীরপুর গ্রামের শাহিদা। অপরিচিত এলাকা। তাই বন্ধু এডিশনাল সিএমএম মুরাদকে জানালাম। ও নিজেই ওসি কর্ণফুলীকে জানায়। ওসি সাহেব কথা বলে জানালেন, তিনি ওয়ালেট সংগ্রহ করবেন। বিকেলে শাহমীরপুর গ্রামে শাহিদার বাড়ি গিয়ে তিনি ওয়ালেট সংগ্রহ করে আমাকে পাঠালেন। শাহিদা তাঁর অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসার জন্য মেডিকেলে ছিলেন। সেখানেই ওয়ালেট কুড়িয়ে পেয়েছেন। এর আগেও দুইদিন আমাকে ফোন করেছেন তিনি। আমি রিসিভ করিনি। শাহিদা চাইলেই ওয়ালেট রেখে দিতে পারতেন। আমার জানার কোনো উপায়ই ছিলো না। কিন্তু তিনি মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে আমাকে খুঁজে বের করে জানিয়েছেন। তাঁর জন্য অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা।  আমি সব গুরুত্বপূর্ণ কার্ড, টাকা অক্ষত অবস্থায় পেয়েছি। শাহিদা এবং তাঁর সন্তানদের জন্য দোয়া করি। আল্লাহ তাদের মঙ্গল করুন। আর সে সাথে ধন্যবাদ জানায়, বন্ধু মুরাদ এবং ওসি কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল মাহমুদসহ পুলিশের সকল সদস্যকে।’

কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল মাহমুদ বলেন, মেয়েকে নিয়ে এমন দুর্দশায় থাকার পরও শাহিদা একটা টাকাও খরচ করেননি। দেশে এখনো ভালো মানুষ আছে- এটাই তার প্রমাণ। তিনি ব্যাগ ও টাকা ফিরিয়ে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

ডিসি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!