‘কাঁদছে হিন্দুরা’ চট্টগ্রাম—সিলেট থেকে কুমিল্লা—কুড়িগ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা

২৩ অক্টোবর দেশজুড়ে গণঅনশন গণঅবস্থান বিক্ষোভ

শারদীয় দুর্গোৎসব চলাকালে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে আগামী শনিবার (২৩ অক্টোবর) দেশজুড়ে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। শনিবার সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত গণঅনশন ও গণঅবস্থান এবং সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল হবে। চট্টগ্রামে এ কর্মসূচি পালিতে হবে নগরের আন্দরকিল্লা চত্বরে। আর ঢাকায় এ কর্মসূচি পালিত হবে শাহবাগ চত্বরে।

শনিবার (১৬ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১২টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের এস রহমান হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত।

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে আজ আর উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এর সবটাই পরিকল্পিত। যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশ থেকে বিতাড়িত করে পুরো দেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করা।

রানা দাশগুপ্ত বলেন, করোনার অতিমারী পরিস্থিতিতে বিগত বছর সারাদেশে দুর্গোৎসব উদযাপিত হয়নি। এবার সংক্রমণ যখন সহনীয় পর্যায়ে তখন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দুর্গাপূজার আয়োজন করলে তা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সম্মিলনের উৎসবে পরিণত হবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু সব আনন্দ ম্লান হয়ে যায় মহাষ্টমীর দিন ১৩ অক্টোবর। এদিন সকাল ১১টায় ভেঙে দেওয়া হয় কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির উত্তর পাড়ে দর্পণ সংঘের অস্থায়ী পূজামণ্ডপ। চানমনি কালিবাড়ির বিগ্রহ ও ফটকে অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করা হয় এবং ১৭টি পূজামণ্ডপের তোরণ ভেঙে দেওয়া হয়।

হামলার পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার ঘটনা ছাড়াও হাজীগঞ্জে দুর্বৃত্তরা ত্রিনয়নী সংঘের পূজামণ্ডপ ও লক্ষী-নারায়ণজী আখেড়ার গেইট ভেঙে ফেলেছে। ভাঙচুর করা হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন জমিদার বাড়ি দুর্গা মন্দির, শ্মশান কালী মন্দির, নবদুর্গা সংঘ পূজামণ্ডপ, দশভূজা সংঘ পূজামণ্ডপ, সোনাইমুড়ী গ্রামের পূজামণ্ডপ, হাজীগঞ্জ শহরের পূজামণ্ডপ, রামপুর লোকনাথ মন্দির, ভদ্রাকালী মন্দির, ত্রিশুল সংঘ পূজামণ্ডপ, রামপুর বলক্ষার বাজার দুর্গামণ্ডপ, হাজীগঞ্জ রাধাগোবিন্দ মন্দির, বাজারগাঁও মুকুন্দ সাহা বাড়ির দুর্গা মন্দির এবং হাটিলা গঙ্গানগর দুর্গামন্দিরে।

আরও পড়ুন: ‘হিন্দু নির্যাতন’—এভাবেই একদিন হিন্দুশূন্য হয়ে যাবে বাংলাদেশে

লক্ষ্মী-নারায়ণজী আখেড়ায় আক্রমণ চলাকালে মানিক সাহা নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। একইদিন হাতিয়ার ৭টি মন্দির ভাঙচুর করা হয়। মন্দিরগুলো হলো- শংকর মার্কেটের আশুতোষ ডাক্তার বাড়ির পূজামণ্ডপ, জগন্নাথ মহাপ্রভুর সেবাশ্রম পূজা মন্দির, রাধাগোবিন্দ সেবাশ্রম পূজা মন্দির, শ্রী লোকনাথ মন্দির পূজামণ্ডপ, তপোবন আশ্রম পূজা মন্দির, গুরুচাঁদ সত্যবামা পূজা মন্দির ও হাতিয়া পৌরসভা কালী মন্দির। একইসঙ্গে চার-পাঁচটি ঘরও ভাঙচুর করা হয়েছে।

মহাষ্টমীর দিন লক্ষীপুর জেলার রামগতি সীতারাম ঠাকুর সেবাশ্রম, গাজীপুরের কাশিমপুরে সুবল দাসের মন্দির ও কাশিমপুর বাজার কালী মন্দির ভাঙচুর এবং লুটপাট করা হয়। একইদিন কুড়িগ্রামের উলিপুর, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, হবিগঞ্জের বাহুবল, সিলেটে জকিগঞ্জের কালিগঞ্জ বাজার, ভোলা জেলার নবীপুরে বেশ কয়েকটি মন্দির ও মণ্ডপে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।

ওইদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালীর শেখেরখীল ও নাপোড়া গ্রামে হামলা চালায় সাম্প্রদায়িক দুৰ্বৃত্তের দল। এদের নেতৃত্ব দেয় মো. সাবের আহমেদ, মো. রিদোয়া ও মো. শামছুল ইসলাম। এরা সবাই শেখেরখীল, গণ্ডামারা ও নাপোড়ার বাসিন্দা।

এদের হামলায় শেখেরখীল সর্বজনীন মন্দির ধ্বংস হয়েছে। হরি মন্দিরের সামনের সড়কের ২০টি হিন্দুর দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। গুরুতর আহত হয়ে সুকুমার দাস বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আহত হয়েছেন সমীর দেব, দুলাল দেব, জুয়েল শীল ও লিটন দেব।

শেখেরখীল সর্বজনীন মহাশ্মশানের সীমানা প্রাচীর ও মন্দির ভাংচুর করা হয়েছে। নাপোড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় সর্বজনীন কালীবাড়ি। নাপোড়া বাজার থেকে কালীমন্দির পর্যন্ত সড়কে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় ৩০টি দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। হামলায় গুরুতর আহত হয়ে জহর লাল দেব নামে একজন বর্তমানে ডুলাহাজরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এছাড়া হামলায় আহত হয়েছেন রতন শিকদার, আশুতোষ দেব, অনুপম দেব, জগদীশ পাল ও বোটন দেব। তাঁরা বাঁশখালী উপজেলা হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।

পশ্চিম চাম্বল বাংলাবাজার করুণাময়ী কালীবাড়ি সর্বজনীন পূজা কমিটির দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুরসহ মন্দিরের যাবতীয় তৈজসপত্র লুটপাট করেছে দুর্বৃত্তের দল। এ সময় প্রদীপ দাস, রঞ্জিত দাস ও সবিতা বালা আহত হন।

শীলকূপে দাসপাড়া সর্বজনীন দুর্গামণ্ডপ, কৈবল্য যুব সংঘ পূজামণ্ডপ ও শীলপাড়া পূজামণ্ডপে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে।

আরও পড়ুন: হিন্দুদের তীর্থস্থানে নামাজ পড়ে ‘উস্কানিমূলক স্ট্যাটাস’, আটক সেই যুবক

১৩ অক্টোবর রাতে কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা শীলখালীর দুটি পূজামণ্ডপের প্রতিমা এবং হরি মন্দিরে লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়েছে। এছাড়া ১৬টি ঘরে হামলা করে লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। মগনামা ইউনিয়নের ১২টি ঘর ভাঙচুর ও লুটপাট এবং ১টি ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। স্থানীয় সরস্বতী মন্দিরের দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়।

পেকুয়া সদর ইউনিয়ন, বারবাকিয়া ইউনিয়ন ও চকরিয়ার ৫টি পূজামণ্ডপ, লোকনাথ মন্দির লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়েছে।

মহানবমীর দিন ১৪ অক্টোবর বান্দরবানের লামা উপজেলার লামাবাজারের কেন্দ্রীয় হরিমন্দির দুর্গা পূজামণ্ডপে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাঙচুর করে দুর্বত্তের দল। এই হামলায় ৫০ জন আহত হন। এর মধ্যে গুরুতর আহত ১০ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৮ জনকে ভর্তি করা হয় জেলা হাসপাতালে।

এদিন সন্ধ্যার পর চট্টগ্রামের বন্দর থানাধীন কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাশে জুলদা জেলেপাড়া পূজামণ্ডপে স্থানীয় জয়বাংলা ক্লাবে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলা চালায় ইলিয়াস মেম্বার, জয়নাল ও মনিরের নেতৃত্বে। জয়নাল-মনির এ দুই ভাই বিএনপি থেকে সম্প্রতি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দুলাল মাহমুদকে হামলাকারীদের প্রতিরোধে কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি।

একইদিন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে সর্বজনীন দুর্গামন্দির এবং হরি মন্দিরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।

খুলনার রুপসা মহাশ্মশান ও শ্মশান কালীমন্দির থেকে ১৮টি তাজা বোমা উদ্ধার করেছে র‌্যাব।

এরই প্রেক্ষাপটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গত ১৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার এক ভাষণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। এতে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিন্দু সম্প্রদায়ৈর মনোবল বেশ বৃদ্ধি পায়। তিনি অরাজকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ার উচ্চারণ করেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরও গত ১৫ অক্টোবর নোয়াখালীর চৌমুহনীতে এবং চট্টগ্রাম মহানগরীতে আবারও সাম্প্রদায়িক হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। চৌমুহনীতে রাধামাধব মন্দির, ইসকন মন্দির, রাম ঠাকুর মন্দির ধ্বংস করে দেয় সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা।

মঙ্গলা পূজামণ্ডপ, রাম ঠাকুর পূজামণ্ডপেও হামলা চালানো হয়। বিজয় পূজামণ্ডপের সদস্য যতন সাহাকে তারা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। ইসকন মন্দিরের প্রভু মলয় কৃষ্ণ দাসের মাথায় আঘাত করে তাকে নির্মমভাবে খুন করেছে। ১৬ অক্টোবর সকালে ইসকন মন্দিরের সামনে পুকুরে জনৈক ভক্তের মরদেহ ভেসে উঠতে দেখা গেছে।

চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায়ও তারা বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির জেএম সেন হলের পূজামণ্ডপে হামলা চালায় ও তোরণ ভেঙে ফেলে। এছাড়া হাজারী গলি, দেওয়ানজী পুকুর পাড়, রাজাপুকুর লেইনেও তারা হামলা চালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়।

আরবি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!