করোনায় মৃত্যু—বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ ‘কবরে’ নিতে বাধা, অ্যাম্বুলেন্স ঠেকাতে ‘ব্যারিকেড’

মিরসরাইয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাজেদ উল্ল্যাহ’র লাশ দাফনে বাধা দিয়েছে গ্রামবাসী ও বাড়ির লোকজন।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘শেষ বিদায়ের বন্ধু’র সদস্যরা লাশের গোসল ও দাফনের ব্যবস্থা করলেও দেওয়া হয়নি গার্ড অব অনার। উপস্থিত ছিলেন না প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তাও।

জানা যায়, গত ৩০ জুলাই মিরসরাইয়ের করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম জোয়ার গ্রামের আবদুর রশীদ মুহুরী বাড়ির নুর মোহাম্মদের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাজেদ উল্ল্যাহ’র শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। সাজেদ উল্ল্যাহ’র সঙ্গে তার স্ত্রী লুৎফুর নাহার (৬৫) ও তার পরিবারের ৫ সদস্যেরও করোনা শনাক্ত হয়।

মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) দিবাগত রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মো. সাজেদ উল্ল্যাহ মারা যান।

মৃত্যুর পর তাঁর দুই ছেলে চট্টগ্রাম নগর থেকে লাশ বাড়িতে নিয়ে আসলে বাড়ির লোকজন ও গ্রামবাসীরা দাফনে বাধা দেয়। পরে তাঁরা ‘শেষ বিদায়ের বন্ধু’ সংগঠনের মিরসরাই সদর ইউনিয়ন কার্যালয়ে লাশের গোসল শেষে অ্যাম্বুলেন্স করে লাশ কবরস্থানে নিয়ে যান। লাশ নেওয়ার পর গ্রামের মসজিদের ইমামও জানাযা পড়াতে আসেননি।

এ বিষয়ে মো. সাজেদ উল্ল্যাহ’র ছেলে হোসেন মো. জাহাঙ্গীর বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাবার মৃত্যুর পর গ্রামের লোকজন লাশের গোসল করানো, কবরের মাটি খোঁড়া ও দাফন করতে পারবে না বলে জানায়। আমাদের বাড়ির গালিব নামে একজন বাড়ির প্রবেশমুখে বাঁশ পুঁতে দেয়, যাতে অ্যাম্বুলেন্স বাড়িতে ঢুকতে না পারে। পরে বিষয়টি করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়নকে জানালে তিনি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘শেষ বিদায়ের বন্ধু’র মাধ্যমে লাশ পরিবহন ও গোসলের ব্যবস্থা করেন। লাশ বাড়িতে নেওয়ার পর গ্রামের মসজিদের ইমাম জানাযার নামাজ পড়াতে অস্বীকৃতি জানালে শেষ বিদায়ের বন্ধু’র করেরহাট ইউনিয়ন টিম লিডার মাওলানা ইসমাঈল জানাযায় ইমামতি করেন।

তিনি আরও বলেন, আমি বুধবার সকাল ৬টায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা’র বাসায় যাই বাবার মৃত্যুর খবরটি জানানোর জন্য। তিনি ঘুম থাকায় দেখা করতে পারিনি। তবে নিরাপত্তা প্রহরীকে বাবার মৃত্যুর বিষয়টি জানিয়ে এসেছি। পরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কবির আহমেদকে মোবাইলে বাবার মৃত্যু ও জানাযার সময় সকাল ৯টায় নির্ধারণের বিষয়টি জানাই। তিনি গার্ড অব অনারের বিষয়ে ইউএনওকে জানাবেন বলে আমাকে আশ্বস্ত করেন।

করেরহাট ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল আবছার বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাজেদ উল্লাহ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার বিষয়টি শুনেছি। আমি নিজেও অসুস্থ হওয়ায় জানাযায় যেতে পারিনি। তাঁর বাড়ির লোকজন ও গ্রামবাসীর বিরোধিতার কারণে পরিবারের লোকজন তাড়াহুড়া করে দাফন করে চলে গেছে বলে শুনেছি।

শেষ বিদায়ের বন্ধু সংগঠনের সমন্বয়ক (সেবা) মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাজেদ উল্ল্যাহ’র দাফনে এলাকাবাসী বাধা দেয়। পরে করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন ও তাঁর ছেলে হোসেন মো. জাহাঙ্গীরের আবেদনের প্রেক্ষিতে লাশের গোসল, জানাযা ও দাফনের ব্যবস্থা করেন শেষ বিদায়ের বন্ধু সংগঠনের সদস্যরা।

আরও পড়ুন: শনাক্ত—মৃত্যুর নতুন চূড়ায় চট্টগ্রামের করোনা

করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন বলেন, মো. সাজেদ উল্ল্যাহ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করায় তাঁর বাড়ির লোকজন, বিশেষ করে মাদক ব্যবসায়ী গালিব উল্লাহ লাশ দাফনে বাধা এবং লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ না করার জন্য বাড়ির প্রবেশমুখে বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দেয়। পরে আমি, ইউপি সদস্য মো. শহীদ ও নাসিম উদ্দিন রুবেল কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করি এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘শেষ বিদায়ের বন্ধু’ সংগঠনের মাধ্যমে লাশের গোসল, জানাযা ও দাফনের ব্যবস্থা করি।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কবির আহমেদ বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাজেদ উল্ল্যাহ’র লাশ দাফনের জন্য সকাল ১০টায় সময় নির্ধারণ করার কথা বলা হলেও তাঁর পরিবারের লোকজন সকাল ৯টায় তাড়াহুড়া করে দাফন করে ফেলে। ফলে গার্ড অব অনার দেওয়ার সুযোগ হয়নি।

মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মিনহাজুর রহমান বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাজেদ উল্ল্যাহকে গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্য সকাল ১০টায় সময় নির্ধারণ করা হয়। তবে ওনার স্ত্রী করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় পরিবারের লোকজন তাড়াহুড়ো করে সকাল ৯টায় লাশ দাফন করে শহরে চলে যায়। সেজন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার দেওয়া যায়নি।

তিনি আরও বলেন, লাশ দাফনে গ্রামবাসী বাধা দেওয়ার বিষয়টি আমি শুনিনি। এটি জানলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নিতাম।

আজিজ/জেডএইচ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!