ইলিয়াস ব্রাদার্সের শুরুটা হয়েছিল রঙিনভাবে। তবে রঙিন সেই আকাশ ধীরে ধীরে ছেয়ে যাতে থাকে কালো মেঘে। হালের পরিস্থিতি এমন— ব্যাংক ঋণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প গ্রুপ।
ব্যাংকের একের পর এক খেলাপি ঋণের মামলায় কাহিল অবস্থা এ শিল্প গ্রুপটির। এর মধ্যে আবার ৫ পরিচালককে গ্রেপ্তার করতে নির্দেশও দিয়েছেন আদালত। ব্যবসায়ীরা বলছেন— ছেলে সামসুল আলমের কারণেই সুনাম নষ্ট হচ্ছে বাবা ইলিয়াসের।
যে ব্যাংকে যত ঋণ
ইলিয়াছ ব্রাদার্সের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকে ২৮০ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকে ২৭০ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংকে ৭৩ কোটি, ইসলামী ব্যাংকে ৬৩ কোটি, এবি ব্যাংকে ৬২ কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ৫৫ কোটি, সিটি ব্যাংকে ৫৫ কোটি, ব্যাংক এশিয়ায় ৩৯ কোটি, ওয়ান ব্যাংকে ৩০ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ২৪ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ১৮ কোটি, পূবালী ব্যাংকে ৭ কোটি এবং এক্সিম ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৪ কোটি টাকা।
যাদের গ্রেপ্তারের আদেশ
ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড খাতুনগঞ্জ শাখার ১৮৩ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৫৭৩ টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের মামলায় ইলিয়াছ ব্রাদার্স লিমিটেডের পাঁচ পরিচালককে গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়া হয়। সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) এ আদেশ দেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান।
গ্রেপ্তারের আদেশ পাওয়া এ পাঁচজন হলেন— ইলিয়াছ ব্রাদার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সামসুল আলম, ইলিয়াছ ব্রাদার্স লিমিটেড কোম্পানি ও এডিবল অয়েল রিফাইনারি ইউনিট-২ এর চেয়ারম্যান নুরুল আবছার, পরিচালক মো. নুরুল আলম, পরিচালক (ব্যবস্থাপনা পরিচালকের স্ত্রী) কামরুন নাহার বেগম ও পরিচালক তাহমিনা বেগম (নুরুল আবছারের স্ত্রী)।
গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন সামসুল
২০১৯ সালে আর্থিক লেনদেন সংশ্লিষ্ট অপর এক মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন ইলিয়াস ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সামসুল আলম।
আরও পড়ুন: ‘কাঁধে ব্যাংক ঋণ’ ইলিয়াস ব্রাদার্সের শামসু—মিজান দেশ ছাড়তে মানা
এর আগে চলতি বছরের ২৩ জুনও ইলিয়াস ব্রাদার্সের ওই পাঁচজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন আদালত। সাউথইস্ট ব্যাংকের দায়ের করা অর্থঋণ জারি মামলায় এ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান।
আবার ২০১২ সালে মামলা করেছিল ন্যাশনাল ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা। সেই মামলায়ও আদালত ইলিয়াছ ব্রাদার্সের পাঁচ পরিচালকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন।
২০১২ সালে ৭৪ কোটি ৮০ লাখ ৫৫ হাজার ৪৩৫ টাকা পাওনা আদায়ে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করে সাউথইস্ট ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা। ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মামলাটির রায় হয়।
স্বপ্নিল শুরু
ইলিয়াস ব্রাদার্সের শুরুটা ছিল স্বপ্নের মতো। স্বাধীনতার আগে ভাইকে নিয়ে ‘ইলিয়াস ব্রাদার্স’র যাত্রা শুরু করেন মো. ইলিয়াস। এরপর ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে রূপ পায়।
শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠানটির মূল বিনিয়োগ ছিল ভোগ্যপণ্যে। এ খাতে স্বাধীনতার আগের সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় ছিল স্বাধীনতার পরেও। ইলিয়াস ব্রাদার্সের নামের পাশে একে একে যুক্ত হতে থাকে জিপি/সিআই শিট, গ্লাস শিট, সয়াবিন তেল, কাগজ ও বোর্ড, তৈরি পোশাক, ব্রিকফিল্ড।
তবে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে ‘দাদা’ ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল ও মিনারেল ওয়াটারে। প্রচুর লাভও আসতে থাকে এসব ব্যবসা থেকে।
ছেলে—নাতিতে হারিয়ে গেছে দাদা
‘দাদা’ ব্রান্ডে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন মো. ইলিয়াস। কিন্তু তাঁর সেই অর্জন ধরে রাখতে পারেনি ছেলে ও নাতি। মূলত নব্বইয়ের দশকে ইলিয়াসের মৃত্যুর পর শুরু লোকসানের গল্পের।
আরও পড়ুন: পুত্র-নাতির দিশাহীন দৌড়, দেনায় গিলে খাচ্ছে ‘দাদা’র ইলিয়াস ব্রাদার্সকে
ইলিয়াসের মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে আসেন নুরুল আবছার ও সামসুল আলম। ব্যবসা সম্প্রসারণে নিতে থাকেন একের পর এক ব্যাংক ঋণ। কিন্তু তখন ব্যবসায় চলছে ভাটার টান। নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় আসে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প গ্রুপটির নাম।
শেষদিকে প্রতিষ্ঠানের হাল ধরার চেষ্টা করেন ইলিয়াসের নাতি শোয়েব রিয়াদ। নতুন কিছু প্রকল্পে বিনিয়োগ করেনও তিনি। কিন্তু এতে এতটুকুও কমেনি ঋণের বোঝা। সবমিলিয়ে লোকসানের ধাক্কায় এখন অস্তিত্ব সংকটে ‘ইলিয়াস ব্রাদার্স’।
আলোকিত চট্টগ্রাম