সেবার অন্যতম খাত আইন পেশাকে পুঁজি করে প্রতারণার বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে এক আইনজীবীর বিরুদ্ধে। অভিযোগকারীর তালিকায় স্থানীয় মেম্বার যেমন আছেন, তেমনি আছেন খোদ তাঁর সৎ বোনও!
আইনজীবী জহিরুল ইসলাম প্রকাশ উকিল জহিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বাবার সব সম্পদ কৌশলে আত্মসাৎ করে বঞ্চিত করেছেন সৎ বোনকে। এক জায়গা একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেছেন। এমনকি প্রতারণার মাধ্যমে অন্যের সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার গুরুতর অভিযোগও আছে উকিল জহিরের বিরুদ্ধে।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আইনজীবী জহিরুল ইসলাম প্রকাশ উকিল জহির। যিনি বাঁশখালী পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকার ছৈয়দ আহাম্মদের ছেলে।
অভিযোগ আছে, নিজের বাবাকে জিম্মি করে সৎ বোনদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করেছেন উকিল জহির। সেই সম্পদ আবার বিক্রিও করে দিয়েছেন।
সৎ বোন মাশেদা বেগম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার খুব কষ্টের সংসার চালাতাম। উকিল জহিরের সম্মতিতে বাবার ভিটায় আমি একটি ঘর করেছিলাম। ঘরের কাজ মোটামুটি শেষ হয়ে গেলে তিনি হঠাৎ কাজ বন্ধ রাখতে বলেন। এখনও আমার সেই ঘরের নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে।
মাশেদা বলেন, আমার বাবার প্রচুর সম্পদ ছিল। শেষ বয়সে বাবাকে শহরে নিয়ে জিম্মি করে উকিল জহির বেশিরভাগ সম্পদ আমমোক্তারনামা মূল্যে বিক্রি করে দেন। এসব কারণে আমার বাবাকে শেষজীবনে ভিক্ষা করে খেতে হয়েছে। গত বছরের ২৯ আগস্ট জহির চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে বাবাকে বন্দি রেখে মেরে ফেলেন। পরে বাবাকে বসা অবস্থায় দাফন করতে হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, আমার বাবার উত্তরসুরী হিসেবে যা সম্পদ পাওয়ার কথা তা তিনি আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন না। জমির ভাগ নিয়ে আমরা চেয়ারম্যনের কাছে বিচার চেয়েছি। কিন্তু উকিল জহির শহর থেকে বাড়ি না ফেরার কারণে কোনো মীমাংসা হচ্ছে না।
এ বিষয়ে স্থানীয় মেম্বার আবুল হোসেন আবু বলেন, উকিল জহির সব সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছেন একটি বড় শিল্প গ্রুপকে। তাছাড়া এক জায়গা একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেছেন। নিজের জায়গার বাইরে গিয়ে তিনি অন্যের সম্পদ নিয়ে টানাটানি করেন। সৎ বোনদেরও তিনি জায়গা-সম্পদ দেননি। এ বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ আসলেও তিনি চট্টগ্রাম থেকে না আসার কারণে কোনো সুরাহা করা যাচ্ছে না।
বাবা হত্যার সত্যতা জানতে কবর খননকারী আমিরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, উকিল জহিরের বাবাকে আমি নিজ হাতে কবর দিয়েছি। তিনি বসা অবস্থায় মারা যাওয়ার কারণে তার লাশ সোজা করা যায়নি। বাঁকানো অবস্থায় কবর দিতে হয়েছে।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ১৬ মার্চ ২৩৯২ দলিলে সোহাগ খাতুনের (তাঁর দাদার বোন) বসতবাড়ি ও পুকুর স্থানীয় ভূমিদস্যু আহমদ হোসেনের কাছে বেচে দেন মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে। ওই দলিল দিয়ে ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালের সহযোগিতায় ৩৪৩৫ নং একটি নামজারি খতিয়ানও সৃজন করেন আহমদ হোসেন । পরে অন্যের বসতবাড়ি হওয়ায় তা বাতিল করেন বাঁশখালীর সহকারী কমিশনার (ভূমি)।
কিন্তু আহমদ হোসেন, উকিল জহির তাঁর ভূমিদস্যু দলের সহযোগিতায় বাতিল করা খতিয়ান দিয়ে অন্যের ভূমি দখল করার চেষ্টা করলে বাঁশখালী থানায় অভিযোগ করা হয়। গত ২৯ আগস্ট এই অভিযোগ করা হয় (নম্বর ২২৩৭)। তবে অভিযোগ করে কোনো সুফল পাওয়া যায়নি অলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী।
এদিকে স্থানীয় বাসিন্দা গুরা মিঞা হাজী তার একমাত্র অবাধ্য সন্তান রফিককে ১৯৮৫ সালের ১৮ জুন ১৯৮৬ নম্বর শপথনামা মূলে বাবা-ছেলের সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ১৯৮৬ সালের ২২ জুন তার সব সম্পত্তি আবদুল হক, মাহমুদুল হক, আজিজুল হক, ছৈয়দুল হক ও নজরুল হককে রেজিস্ট্রি মূলে দান করেন। কিন্তু দান করা সম্পত্তি রফিক পুনরায় বিক্রি করলে নাতিরা তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এজন্য আত্মীয় হিসেবে উকিল জহিরকে নিয়োগ দেন তারা। কিন্তু ২০০০ সালের ২৫ মে মামলার নথিপত্রে স্বাক্ষরের প্রয়োজন বলে তিনি বাঁশখালী সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে নিয়ে ২৬০৪ নম্বর কবলামূলে এবং ২০০১ সালের ৪ জুন ২৮৪৭ নম্বর কবলামুলে ১৯৯৬ সালের ৬ আগস্ট তারিখের ৩৫০০ নম্বর কবলা মূলে প্রায় ১২০ শতক জমি নিজের নামে রেজিস্ট্রি নিয়ে নেন।
ভুক্তভোগীদের একজন ছৈয়দুল হক বলেন, ১৯৮৬ সালে আমার দাদা দানপত্রের মাধ্যমে আমাদের সম্পদ দেন। কিন্তু কাগজপত্র না বুঝার কারণে উকিল জহিরের কাছে এসব কাগজপত্র গচ্ছিত রাখা হয়। তিন বছর পর আমার দাদা মারা গেলে উকিল জহির আমাদের জানায় বিভিন্ন মানুষ আমাদের কাছ থেকে জায়গা পাবে। এসব বলে বিভিন্ন শালিস-বৈঠকে নিয়ে গিয়ে আমাদের কাছ থেকে তিন দফায় স্বাক্ষর নিয়ে কবলা বানিয়ে নেন। তিন দফার মধ্যে দুই দাগের ২৬ গণ্ডা ও ১২ গণ্ডা তিনি নিজ নামে করে নিয়েছেন। পরে আমার বাবাকে রেজিস্ট্রি দিবেন বলে এক কানি সম্পদ নিয়ে নেন। সর্বমোট ২ গণ্ডা কম তিন কানি থেকে। বর্তমানে মাটি কেটে দিনাতিপাত হচ্ছে আমাদের।
উকিল জহিরের প্রতারণার শিকার ফরিদ নামের একজন বলেন, আমার কাছ থেকে ৮ বছর আগে ১০ হাজার টাকা নিয়ে ১০ কড়া জায়গা রেজিস্ট্রি দিবে বলেন। কিন্তু আমি জায়গা রেজিস্ট্রি না নেওয়ার কারণে সেই জায়গা এক বড় শিল্প গ্রুপকে রেজিস্ট্রি করে দেন উকিল জহির।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জাল দলিল তৈরিতে উকিল জহিরকে সহায়তা করেন বাঁশখালী গণ্ডামারা ৩নং ওয়ার্ড মোয়াজ্জিন বাড়ির মরহুম নওসা মিয়ার ছেলে আহমদ হোসেন, পশ্চিম বড়ঘোনা এলাকার মৃত হাজী এজহার মিয়ার ছেলে বদরজ্জমা, নুরুল আলমের ছেলে শহিদুল্লাহ, আহমদ হোসেনের ছেলে জসিম উদ্দিন, চাম্বল তহশিল অফিসের দালাল কামরুল ইসলাম বাদশা, সহযাগী মো. সফিউল্ল্যাহ ও মো. ইয়াকুব।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জহিরুল ইসলাম আলোকিত চট্টগ্রামকে বলেন, আমার বাবা উপস্থিত থেকে জমি বিক্রি করেছে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে। আমার সম্পদের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে আমাদের এসব সম্পদ গ্রাস করার জন্য শত্রুপক্ষ এমন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তাছাড়া আমার সৎ বোনের জামাই আমার বাবা থেকে জোর করে জায়গা-সম্পদের কাগজপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এ কারণে আমার বাবা আমাকে আমোক্তার দিয়েছে। যারা আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করছে তারা সকলে আমার শত্রু।
তিনি বলেন, আমি বাড়ি-ঘরে থাকি না। এসব আমার শত্রুদের চাল। তারা আমার জায়গা-জমি দখলে নিতে চাই। এসব কারণে বাঁশখালী সিভিল কোর্টে মামলা করতে হচ্ছে। তাছাড়া শত্রুদের এসব ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচতে গ্রামে না গিয়ে আমি শহরে বসবাস করছি।
তিনি আরও বলেন, কোভিডের সময় আমার বাবা গ্রামে ছিলেন। এসময় একজন মহিলা দিয়ে আমার বাবাকে দেখাশোনা করাতাম। বাবা গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর ওনাকে চট্টগ্রাম নিয়ে এসে চিকিৎসা করেছি। এর ১০-১৫ দিন পর তিনি মারা যান।
জহিরুল ইসলাম দাবি করেন, আমার বাবার কোনো রোগ ছিল না। তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছেন। আমার মেয়ে বর্তমানে এমবিবিএস ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। সেইসময় তার স্যারদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসাসেবা চলেছে।
সৎ বোন মাশেদার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার এক সৎ বোন আমার বাবা থাকা অবস্থায় এক কানি জমি দখল করে ঘর করেছে। অন্য এক সৎ বোনের স্বামী মারা যাওয়ার পর সেও আমার সেই সৎ বোনের স্বামীর যোগসাজশে আমার ঘর ভেঙে ঘর তৈরি করছিলেন। এজন্য আমি তাকে বলেছি অর্ধেকে ঘর করতে এবং অন্য অর্ধেকে আমার থাকার মতো জায়গা রাখতে। কিন্তু সে সেটি করেনি। তাছাড়া আমার ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে। তাদের জন্য সম্মন্ধ করতে গেলে বাড়ি-ঘর দেখতে চাইলে আমি তো প্রশ্নবিদ্ধ হবো।